চুপ হয়ে গেল রবিন। সঙ্গে যাবার মত জোরাল যুক্তি দেখাতে পারল না আর কেউ।
ইসাবেলের ব্যাপারে অদ্ভুত একটা ধারণা বাসা বাঁধছে কিশোরের মনে। ধারণাটা হয়েছে খুব ক্ষীণ সূত্র থেকে। ক্যাম্পের সামান্য আলোয় দেখা কব্জির দাগ। রবিন বলছে কন্ট্যাক্ট লেন্স পরে মহিলা। সামান্য সূত্র, তবে অবহেলা করা উচিত নয়। অতি সাধারণ জিনিসও মাঝে মাঝে জটিল রহস্যের সমাধান করে দেয়। ইসাবেলের কব্জিতে দাগ সত্যিই আছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার একটাই উপায়, আরেকবার কাছে থেকে ভালমত দেখা।
বেশ, যাও, মুসা বলল অবশেষে। তবে সাবধানে থেক। মহিলার কাছে এখন একটা রাইফেল আছে।
বারোদুটোকে গুহা থেকে বের করে আনল টনি। জানাল, ডজের হুঁশ ফিরেছে। আমাকে দেখেই গালাগাল শুরু করল। ছাড়া পেলে আমাকে কি কি করবে, পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে।
ইসাবেলের বারোর পেটে জোরে এক চাপড় মারল কিশোর। চলতে শুরু করল ওটা। পাশে পাশে এগোল শারি। কিশোর ঢুকে পড়ল দুটো জানোয়ারের মাঝখানে। মাথা নুইয়ে রেখেছে, যাতে সহজে কারও চোখে না পড়ে।
ওপরেও উঠল না বারোদুটো, নিচেও নামল না। যতটা সম্ভব সমান্তরাল জায়গা ধরে চলতে লাগল। এখানকার পাহাড়ের এটা এক অদ্ভুত ব্যাপার। খাড়া ঢাল আছে, আবার অনেকখানি জায়গা জুড়ে ঢালের গায়ে সমান জায়গাও আছে, টেবিলের মত।
ওপর দিকে মুখ তুলতে আরও অনেক গুহামুখ নজরে পড়ল কিশোরের। কিন্তু মাটিতে কোন চিহ্ন দেখতে পেল না, যেগুলো বলে দেবে কোন গুহাঁটার দিকে মানুষ গেছে।
চলছেই ইসাবেলের বারো। তারপর কোন রকম জানান না দিয়েই আচমকা থেমে গেল।
ওটার পাশে থমকে দাঁড়াল শারি। মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল কিশোর। শখানেক গজ ওপরে পাহাড়ের গায়ে একটা ফাটল মত চোখে পড়ল। পাথরের আড়ালে থেকে, যতটা সাবধানে সম্ভব ক্রল করে এগোল সেটার দিকে।
তাকে অনুসরণ করল না ইসাবেলের বারো। তবে নড়লও না। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। কাছেই হোট একটা সে ঝোঁপ দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল শারি। পাতা ছিড়ে চিবাতে শুরু করল। দেখাদেখি অন্য বারোটাও গিয়ে তাতে মুখ দিল। কোন শব্দ করল না।
ভুল করলাম না তো? ভাবল কিশোর। পাহাড়ের এই সরু ফাটলে নিশ্চয়ই ঢোকার পথ নেই। আর তাহলে ওখানে ক্যাম্প করাও সম্ভব নয় ইসাবেলের পক্ষে। তবু, আরেকটু কাছে এগিয়ে দেখা যাক, কিছু আছে কিনা।
ঘাড়ে হাত পড়ল এই সময়, শীতল স্পর্শ। শক্ত করে চেপে ধরেছে যেন।
তার মুখের কাছ থেকে একটু দূরেই মাটি থেকে যেন গজিয়ে উঠেছে জিনিসটা। আসলে গেড়ে দেয়া হয়েছে। একটা কাঠের ক্রুশ। আড়াআড়ি বাঁধা দুটো কাঠের বাঁধনের কাছের একটা কোণ আটকে গিয়েছিল ওর ঘাড়ে, মাথা তোলার সময়।
নাম খোদাই করা রয়েছে ক্রুশটাতে। ইগনাসিও।
পেয়ে গেল তাহলে! গুহার বাইরেই কবর দেয়া হয়েছে কংকালটাকে। তার মানে কাছেই কোথাও রয়েছে পঞ্চো ভিলার গুহা। যেটাতে লুকানো রয়েছে পেসোগুলো।
ইসাবেল কি দেখে ফেলেছে? ওই গুহাতে গিয়েই ক্যাম্প করেছে সে? নাকি ওপরে উঠে বসে আছে কোনখানে? ওই ফাটলের ভেতর?
ওপরে থেকে থাকলে এতক্ষণে বারোদুটোকে দেখে ফেলার কথা। দেখে থাকলে জানার চেষ্টা করবে কেন এসেছে ওগুলো।
মাটিতে লম্বা হয়ে পড়ে রইল কিশোর। অপেক্ষা করছে।
মিনিটখানেকের বেশি থাকতে হলো না। মেকসিকান মহিলার পরিচিত মূর্তিটা চোখে পড়ল। পশমের তৈরি ঢিলাঢালা স্কার্ট, লাল শাল, কালো বেনি। গুহা থেকে বেরিয়ে তাকিয়ে রয়েছে নিচে বারো দুটোর দিকে।
হাতে রাইফেল। বোল্ট টানার শব্দ কানে এল কিশোরের।
যাও। নিজেকে বলল কিশোর। সময় হয়েছে ইসাবেল সম্পর্কে সমস্ত কথা জানার।
মাথা নামিয়েই রাখল সে। ভাবছে, যদি তার অনুমান ভুল হয়ে যায়? যদি তার সন্দেহের জবাব রাইফেলের বুলেট দিয়ে দেয় ইসাবেল?
ঝুঁকি না নিলে জানা যাবে না। চিৎকার করে বলল সে, আম্মা, আমি! আমি টনি, আম্মা!
১৪
কিশোরের জীবনের দীর্ঘতম দশটি সেকেন্ড নড়ল না ইসাবেল।
তারপর রাইফেল হাত থেকে ফেলে দৌড়ে নামতে লাগল কিশোরের দিকে।
টনি! চেঁচিয়ে বলছে মহিলা, টনি! কোথায় তুই, বাবা! ঠিক আছিস? ভাল আছিস?
স্প্যানিশ ছাড়া অন্য ভাষা না জানার ভান করছে না এখন। পরিষ্কার ইংরেজিতে বলছে।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। হ্যাঁ, টনি ভালই আছে। চালাকিটা করার জন্যে আমি দুঃখিত। তবে এছাড়া আপনার সাহায্য পাওয়ার আর কোন উপায় ছিল না। আমাদের সবারই সাহায্য দরকার। টনিরও।
কয়েক গজ দূরে থমকে দাঁড়িয়েছে ইসাবেল। আরও দশটি সেকেন্ড কিশোরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হাসল অবশেষে।
এসো, ডাকল সে। বলো আমাকে, কি হয়েছে।
ফিরে তাকাল কিশোর। শান্ত ভঙ্গিতে পাতা ছিড়ছে বারোদুটো। খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। আর কোনদিকে নজর নেই। মহিলাকে অনুসরণ করে ফাটলটার দিকে এগোল সে।
ডজ কোথায়? রাইফেলটা তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল মহিলা। পাহাড়ের নিচে যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখল লোকটা আছে কিনা।
ওকে নিয়ে ভাবনা নেই, গুহায় কি ঘটেছে জানাল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাল ইসাবেল। সেফটি ক্যাচ অন করে দিল। টনি আর ওর বাবার চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল আমার। কাল এই গুহাঁটা দেখেছি আমি। ভেতরে দুজনের জিনিসপত্র পড়ে আছে। কিন্তু ঘোড়ার পায়ের ছাপ সব পুরানো। তাই বুঝতে পারিনি কোথায় গেছে ওরা।