হতাশ ভঙ্গি করল কিশোর। পরাজিত, বিধ্বস্ত হয়ে যেন দ্রুত নামতে শুরু করল নালার ভেতর দিয়ে।
ও পাথরের আড়ালে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ডজ। তারপর মাথা নিচু করে দুহাতে রাইফেল ধরে ঢুকল সুড়ঙ্গের ভেতরে।
ওকে আসতে শুনল মুসা। গুহার ঠিক ভেতরেই অপেক্ষা করছে। আশা করছে, মাথা নিচু করেই ঢুকবে ডজ, ঢুকতে হবে ওভাবেই। ঘাড়ে কারাতের কোপ মারার জন্যে চমৎকার একটা সুযোগ পেয়ে যাবে তাহলে।
হাত তুলল সে। আঙুলগুলো সোজা করে শক্ত করে রেখেছে, গায়ে গায়ে চেপে লেগে রয়েছে একটা আরেকটার সঙ্গে। এভাবে ডজের ঘাড়ে একটা কোপই যথেষ্ট। মাথা তোলার আর সুযোগ পাবে না। ঢলে পড়বে মাটিতে।
গুহায় ঢুকল ডজ। সাপের মত ছোবল হানল যেন মুসার উদ্যত হাত। কিন্তু একটা বারো শব্দ করে ফেলল আর শেষ মুহূর্তে মাথা সোজা করে ফেলল লোকটা। মুসার কোপটা ঘাড়ে না লেগে লাগল তার কাঁধে। হোঁচট খাওয়ার মত ঝাঁকুনি খেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল তার শরীরটা। হাত থেকে রাইফেল ছাড়ল না।
লাফ দিয়ে পেছনে চলে এল মুসা। আরেকবার আঘাত হানার জন্যে উঠে গেল হাত। কিন্তু সামলে নিয়েছে ততক্ষণে ডজ। রবিন আর টনিকে পরাজিত করার সময় যেমন বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল শরীরে, তেমনি খেলল আরেকবার। অসাধারণ ক্ষিপ্র লোকটা। চিতাবাঘকেও হার মানায়। কখন ঘুরল বুঝতেই পারল না যেন মুসা। শুধু দেখল, তার দিকে ঘুরে গেছে ডজ। রাইফেলের নল বুকের দিকে তাক করা।
হাত নামাল মুসা।
পরমুহূর্তে আন্দাজ করল, ডজের তুলনায় তার একটা সুবিধা বেশি। রোদ থেকে ভেতরে এসেছে লোকটা, তীব্র আলো থেকে আবছা অন্ধকারে, চোখে সয়নি এখনও। দ্রুত কিছু করতে পারলে হয়ত কাবু করে ফেলতে পারবে ডজকে, গুলি করার আগেই।
একপাশে সরে গেল সে। বোঝার চেষ্টা করল, ডজ দেখতে পেয়েছে কিনা, কিছু করতে গেলে গুলি খাবে কিনা। কিছুই বুঝতে পারল না। এতগুলো ঘটনা ঘটে গেল মুহূর্তের মধ্যে। ঝুঁকি নিল সে। একপায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে ঘুরল। পাক শেষ হওয়ার আগেই ঝট করে ওপরে তুলে সোজা বাড়িয়ে দিল ডান পাটা। ডজের বুকের সামান্য নিচে লাগল লাথি।
পুরো একটা সেকেন্ড বাঁকা হয়ে রইল ডজ। শ্বাস নিতে পারছে না।
যথেষ্ট সময় পেল মুসা। লাফিয়ে সামনে এগিয়ে কনুই দিয়ে একেবারে মেপে একটা ভয়াবহ আঘাত হানল ডজের ঘাড়ে। মারটা আরেকটু জোরে হলে মরেই যেত র্যাঞ্চার।
ওটোশি-হিজি-অ্যাটি সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, ডজও পারল না। ঢলে পড়ল মেঝেতে। কিছু সময়ের জন্যে বেঁহুশ।
অন্য তিনজন যখন গুহায় ঢুকল, তখনও মেঝেতেই পড়ে আছে সে। দড়ি বের করে শক্ত করে বাঁধল তাকে টনি। খানিক আগেও রাইফেল হাতে যে হম্বিতম্বি করছিল, সে এখন পুরোপুরি অসহায়। তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে চারজনে। উত্তেজনা টের পেয়েই বোধহয় খাওয়া থামিয়ে দিয়েছিল বারো দুটো। আবার মুখ নামিয়ে জই তুলে নিয়ে চিবাতে শুরু করল।
মিনিট খানেক পর রবিন বলল, হুঁশ ফেরে না কেন? দশ পর্যন্ত গুনি।
দরকার কি গোনার, কিশোর বলল। যখন ফেরে ফিরবে।
বাইরে বেরিয়ে এল চারজনে।
যেভাবে আশা করেছিলাম ঠিক সেভাবে ঘটল না, হাসল কিশোর। মুসাই শেষ রক্ষা করল। নইলে গিয়েছিল সব ভন্ডুল হয়ে।
হেসে বাতাসেই হাত দিয়ে একটা কোপ মারল মুসা। জিনিস বটে, কারাতে। খালি দুটো হাত আর পা-ই যথেষ্ট, মারাত্মক অস্ত্র হয়ে যায় ব্যবহারের গুণে।
ঠিক, রবিন বলল। কোন দিন ব্রুস লী হয়ে যাও কে জানে! কিশোর, এরপর কি করব আমরা?
প্রথমে ডজের রাইফেলটা বের করে আনব, কিশোরের আগেই জবাব দিল টনি। একটা রাইফেলের চেয়ে দুটো থাকলে অনেক সুবিধে।
দ্রুত সেই ক্যাকটাসের ঝোপে নেমে এল ওরা, যেখানে রাইফেলটা ছুঁড়ে ফেলেছিল রবিন। খুঁজতে শুরু করল।
খুঁজেই চলল, খুঁজেই চলল। প্রতিটি খাঁজ, গর্ত, পাথরের ফাঁকফোকর, কিছু বাদ দিল না। প্রতিটি কাঁটাওয়ালা ক্যাকটাসের পাতা সরিয়ে সরিয়ে দেখল।
পাওয়া গেল না রাইফেলটা।
ইসাবেল! রবিন বলল, ধারেকাছেই কোথাও ছিল। নিয়ে গেছে।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে লাগল কিশোর। কয়েকবার জোরে জোরে চিমটি কাটার পর বলল, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
কত বুদ্ধি যে থাকে তোমার মাথায়! গুঙিয়ে উঠল মুসা।
আমার ধারণা, কিশোর বলল, ইসাবেল এখানে কোথাও লুকায়নি। চিন্তিত ভঙ্গিটা রয়ে গেছে। ঘাঁটিতে ফিরে গেছে সে।
ঘাঁটি, ভুরু কোঁচকাল মুসা। সেটা আবার কি?
বারোর পিঠ থেকে মালপত্র নামিয়ে নিয়ে গেছে, যাতে কোথাও ক্যাম্প করতে পারে। মিস্টার সাইমন জানিয়েছেন আমাকে, বারোরা খুব বিশ্বস্ত জানোয়ার। সেটার প্রমাণও পেয়েছি আমরা। মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে তাকে আর ছাড়তে পারে না। ফিরে ফিরে যায় তার কাছে। এখন ইসাবেলের বারোটার আকর্ষণ শারির ওপর বেশি, তাই যেতে চাইছে না। কিন্তু যদি শারিকে ওর সঙ্গে যেতে দিই, তাহলে নিশ্চয় পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আমাকে ইসাবেলের কাছে। যেখানে ঘাঁটি করেছে মহিলা।
তোমাকে? বাঁকা চোখে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। একাই সব ক্রেডিট নিতে চাও? আমরা বাদ পড়ব কেন? সবাই গেলে অসুবিধে কি?
অসুবিধেটা হলো, চারজন অনেক বেশি। একসাথে গেলে দেখে ফেলতে পারে ইসাবেল। আমি একা হলে সারাক্ষণ বারোগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থেকে এগুতে পারব। আর শারিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তোমাদের নেই। কাজেই আমাকেই যেতে হচ্ছে।