কিছু বলল না কিশোর। মাথার ভেতরের মগজ নামের কম্পিউটারটা তার চালু হয়ে গেছে বেদম গতিতে।
আরেকটা ধাঁধার সমাধান হলো, বসে গেল খাপে খাপে। ইয়ার্ডের ডাকবাক্সে পাওয়া টেপটায় রেকর্ড করা ছিলঃ মেকসিকোতে এসো না, প্লীজ! মারাত্মক বিপদে পড়বে…
নিশ্চয় ওটা টনিরই কণ্ঠ ছিল। ওর মা কে কোন কারণে সতর্ক করে দিয়ে পাঠানো একটা দীর্ঘ চিঠিরই কিছু অংশ আবার রেকর্ড করা হয়েছিল। কিংবা বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলো রেখে বাকি সব মুছে ফেলা হয়েছিল। তারপর রেখে আসা হয়েছিল ইয়ার্ডের ডাকবাক্সে। কিশোরকে ভয় দেখানোর জন্যে, হুমকি দেয়ার জন্যে এবং এটা করতে গিয়ে একটা চমৎকার সূত্র রেখে এসেছিল।
টনির দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করল কিশোর, তোমার আম্মা কি এখন লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকেন?
হ্যাঁ। মনে হয়। আসলে, কখন যে কোথায়… চুপ হয়ে গেল টনি। আবার অন্য দিকে তাকাল। বলতে চায় না।
চাপাচাপি করল না কিশোর। তবে আরেকটা কথা জানা দরকার। তুমি কি তোমার আম্মার মত দেখতে? তোমার মতই সোনালি চুল?
হ্যাঁ। আমার মত চোখও নীল। কেন?
না, ভাবছি। হাই তুলল কিশোর। শুয়ে পড়ল লম্বা হয়ে। ঘুমালে কেমন হয়?
সবাই রাজি। কয়েক মিনিট পর ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিল ওরা। সুড়ঙ্গ মুখের কাছে ঝোলানো কম্বলটা গিয়ে খুলে নিয়ে এল টনি। স্লীপিং ব্যাগে ঢুকল চারজনেই। তারপর ঘুম।
পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙল কিশোরের। দেখল, বাইরে থেকে সুড়ঙ্গমুখ দিয়ে যেন চুইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে আবছা আলো। প্রথমেই তাকাল, শারি কি করছে দেখার জন্যে। আরে! নেই তো!
তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল সে। শারিকে খুঁজতে লাগল। গুহায় ঢোকার পথের ওপরই দেখতে পেল ওটাকে, বিশ গজ দূরে। তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। মাথা তুলে মোলায়েম ডাক ডাকল বারোটা। হুঁশিয়ারি নয়, বন্ধুত্বপূর্ণ। মুহূর্ত পরেই আরেকটা বারোর ডাক কানে এল, শারির ডাকের সাড়া দিল ওটা বাইরে থেকে। সুড়ঙ্গমুখের নিচে কোনখানে রয়েছে।
ইসাবেলের বারো, ভাবল কিশোর। দ্রুত সরে এল পেছনে। লুকিয়ে পড়ল পাথরের আড়ালে। মুহূর্ত পরেই তার পাশে চলে এল টনি, মুসা আর রবিন। ওরাও ডাক শুনেছে।
মোলায়েম ডাক বিনিময় চলতেই থাকল শারি আর অন্য বারোটার মধ্যে। তারপর একসময় দেখা গেল দ্বিতীয় বারোটাকে। পর্বতের ঢালের একটা নালা ধরে উঠে আসছে।
দুলকি চালে এগিয়ে গেল শারি। অন্য বারোটা কাছাকাছি এলে ওটার গায়ে গা ঘষতে শুরু করল।
ইসাবেলের ব্যরোর লাগাম এখনও পরানো রয়েছে, কিন্তু পিঠের বোঝাগুলো নেই। সূর্য উঠেছে। রোদ বাড়ছে, বাড়ছে আলো। আশপাশটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন। উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল চারজনে।
ইসাবেলকে দেখা গেল না।
চলো, দুটোকেই গুহায় নিয়ে যাই, প্রস্তাব দিল মুসা। শারিকে দেখলেই বুঝে ফেলবে ইসাবেল, আমরা এখানে আছি।
কিশোর আর টনি মিলে দুটো বারোকে বলে বলে নিয়ে গেল গুহার ভেতরে। ওদের অনুসরণ করল অন্য দুজন।
ইসাবেলকে তোমরা পছন্দ করো না, তাই না? টনির প্রশ্ন।
ওই মহিলা আরেকটা ধাঁধা, কিশোর বলল। সে আমাদেরকে বলেছে ডজের ব্যাপারে তোমাদেরকে সাবধান করে দিতে। বলেছে, সে তোমাদের পরিচিত। বন্ধু। অথচ তুমি বলছ, কখনও দেখইনি। এর মানেটা কি? মনে হচ্ছে রবিনের কথাই ঠিক। ধাপ্পাবাজ মহিলা।
দুটো বারোই ক্ষুধার্ত। গুহার ভেতরে নিরাপদ জায়গায় এনেই ওগুলোকে খাবার দিল টনি, পানি ঢেলে দিল গামলায়। মুসা বসল রান্না করতে। তাদের সেই একই খাবার, বীন আর চাল সেদ্ধ।
একসাথে খেতে বসল না ওরা। বাসন নিয়ে সুড়ঙ্গমুখের কাছে চলে গেল কিশোর, পাহারা দেয়ার জন্যে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল সে, যাতে নিচ থেকে তাকে চোখে না পড়ে। আত্মগোপন করে রইল পাথরের আড়ালে। উঁকি দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে দেখল নিচের অঞ্চল। আঁতিপাতি করে খুঁজেও ইসাবেলকে চোখে পড়ল না।
কম্পনটা প্রথমে টের পেল বুকের কাছে। হৃৎপিন্ডের ঝাঁকি নয়, বাইরে থেকে আসছে। যেন পাহাড়ের অনেক গভীর থেকে আসছে। এতটাই জোরাল হলো, হাত থেকে চামচ পড়ে গেল। ভূমিকম্প নয়। লস অ্যাঞ্জেলেসে আজীবন বাস করে আসছে, ভূমিকম্প হলে কি হয় ভাল করেই জানে। এখনকারটা হঠাৎ কোন ঝাঁকুনি নয়। বরং মহাসড়কের ধারে দাঁড়ালে আর পাশ দিয়ে ভারি কোন লরি চলে গেলে যেমন কাঁপতে থাকে মাটি অনেকটা তেমন।
ঘণ্টাখানেক পরে তার জায়গায় পাহারা দিতে এল রবিন। সেই রকম কথা হয়েছে। এক এক করে সবাই দেবে, এক ঘণ্টা পর পর।
কাঁপুনি টের পেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পেয়েছি, রবিন জানাল। ভূমিকম্পের মত কিন্তু মনে হলো না। অন্য রকম। এই পর্বতমালাকে বিশ্বাস নেই, বইয়ে পড়েছি। এখন তার প্রমাণ পাচ্ছি। কখন যে কি ঘটে যাবে বলা মুশকিল। আচ্ছা, কাল যে বনে আগুন লাগতে দেখলাম… না, আগুন তো না, ধোঁয়া, এর কি ব্যাখ্যা, বলো তো?
ফিরে তাকাল সে। পেছনে কিছুই দেখতে পেল না। দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের উঁচু চূড়া। গুহামুখের ওপর থেকে উঠে গেছে অনেকখানি।
কুইন সাবে? রবিনের প্রশ্নের জবাব দিল কিশোর। অর্থাৎ, জানে না।
পাহারায় বসল রবিন। নিচের দিকে তাকিয়ে ইসাবেলকে খুঁজতে লাগল তার চোখ।
কিশোর যখন এসেছিল, তার দুই ঘণ্টা পরে এসে রবিনকে মুক্তি দিল মুসা। নিচে তাকিয়ে মনে হলো তার, একটা নড়াচড়া দেখতে পেয়েছে। স্পষ্ট বুঝতে পারল না। পাখির ডাক ডেকে গুহার ভেতরে বন্ধুদেরকে জানিয়ে দিল তার সন্দেহের কথা।