মনে তো হলো, জবাব দিল কিশোর। স্প্যানিশ ছাড়া আর কোন ভাষা বোঝে না। ওর চামড়ার রঙও মেকসিকানদের মত বাদামী। নিজেও অবাক হয়ে ভাবতে আরম্ভ করেছে এখন, আসলেই মহিলা মেকসিকান কিনা! ডজের ব্যাপারে তোমাকে সাবধান করে দিতে বলেছে আমাদেরকে। তোমার নাকি বন্ধু। তুমি তাকে চেন?
মাথা নাড়ল টনি। নামই শুনিনি কখনও। আর চেহারার যা বর্ণনা শুনলাম, তাতে বুঝতে পারছি, ওর সঙ্গে জীবনে কখনও দেখা হয়নি আমার।
১২
এই পর্বতে গুহার অভাব নেই, টনি বলল। পঞ্চো ভিলা আর তার সাগরেদরা নিশ্চয় একেক সময় একেক গুহায় ঢুকত, লুকিয়ে থাকার জন্যে। তবে আব্বার ধারণা, সে যেটাতে পেসো লুকিয়েছিল সেটা পেয়ে গেছি আমরা।
সন্ধ্যায় যার যার স্লীপিং ব্যাগ বের করে তার ওপর আরাম করে বসেছে তিন গোয়েন্দা। কেরোসিনের চুলায় এক হাঁড়ি খাবার রান্না করেছে টনি, একঘেয়ে সেই বীন আর চাল সেদ্ধ। তিনটে মোম জ্বলছে এখন। সুড়ঙ্গমুখে একটা কম্বল ঝুলিয়ে দিয়ে এসেছে সে, যাতে বাইরে আলো বেরোতে না পারে। এককোণে জই চিবাচ্ছে শারি।
যার যার প্লেটে খাবার দেয়া হলো।
কি করে জানলে তোমরা, আসল গুহাঁটাই খুঁজে পেয়েছ? মুসা জিজ্ঞেস করল। এত গুহার মধ্যে, আলাদা করে চিনলে কি করে?
কিছু কিছু চিহ্ন দেখে। পাথর পড়ে বন্ধ হয়ে ছিল গুহামুখ। ওগুলো কিছু কিছু সরিয়ে যখন ঢুকলাম, পেয়ে গেলাম ইগনাসিওকে।
ইগনাসিও?
ভিলার এক সিপাহী। উনিশশো ষোলো সাল থেকে গুহায় থেকে থেকে তার চেহারা অবশ্যই আর চেনার জো ছিল না। আসলে, চেহারাই আর অবশিষ্ট নেই। শুধুই কঙ্কাল। ইউনিফর্মের কয়েকটা টুকরো তখনও লেগে ছিল। আর তার খুলিটা…
দয়া করে এখন একটু চুপ করবে, বাধা দিয়ে বলল মুসা। আমি এখন এই রাজকীয় খানা গেলার চেষ্টা করছি।
হাসল রবিন। মরা মানুষের কথা শুনলে ভয় পায় আমাদের মুসা। বিশেষ করে অপঘাতে মৃত্যুর কথা শুনলে। মুসার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে হাসল, খাওয়ার রুচিও মষ্ট হয়ে যায়, তাই না? আবার টনির দিকে তাকাল সে। ভূতের বড় ভয়।
ও, টনিও হাসল। ভাবনা নেই, ভূত হতে পারবে না। খ্রিস্টানদের মত করেই কবর দিয়েছি তাকে। আব্বা তার কবরের ওপর একটা ক্রুশ লাগিয়ে দিয়েছে। লিখে দিয়েছে মেসিকোর মহান মিলিটারি হিরো ইগনাসিওর স্মৃতির উদ্দেশ্যে। ইগনাসিও অ্যালেন্ড ছিল অনেকটা আমেরিকানদের জর্জ ওয়াশিংটনের মত, আর…
গুহার মধ্যে তুমি ঢুকেছিলে? প্রসঙ্গটা ভাল লাগছে না মুসার, অন্য বিষয়ে চলে যাওয়ার জন্যে বলল।
মাথা নাড়ল টনি। গাঁইতি আর শাবল দিয়ে কিছু পাথর সরিয়েছি। ওই পর্যন্তই। এর বেশি আর কিছু করতে পারিনি। পেসোগুলো দেখিনি। সে জন্যেই বিস্ফোরক কিনতে গেছে আব্বা।
কখন ফিরবেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
তিন-চার দিনের আগে না। গাঁয়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না, মাত্র কয়েক ঘণ্টা। ওখানে ঘোড়া রেখে যাবে আব্বা। দুটো ঘোড়া নিয়ে গেছে। দরকার আছে। আসার সময় ভারি বোঝা বয়ে আনতে হবে। যাই হোক, আব্বা চলে যাবে চিহয়া হুয়ায়। ওটাই সব চেয়ে কাছের শহর, যেখানে ডিনামাইট আর দরকারী অন্যান্য জিনিস কিনতে পাওয়া যায়।
তার মানে, রবিন বলল। ডজকে আমাদেরই সামলাতে হবে। হয়তো ইসাবেলাকেও। তবে, আমরা চারজন। দুজন মানুষকে কাবু না করতে পারার কিছু নেই।
নতুন বন্ধুদের দিকে তাকাল টনি। ভাল লাগছে আমার। একা আর সামলাতে হবে না ওদেরকে। আরও তিনজনের সাহায্য পাব। ডজের ব্যাপারে যে আমাকে সাবধান করে দিলে তার জন্যে আরেকবার ধন্যবাদ দিচ্ছি তোমাদেরকে। তোমরা আমাকে চিনতেও না।
ইয়ে… কিশোরের মনে পড়ল, ওদের পরিচয়ই এখনও দেয়া হয়নি টনির কাছে। শুধু নাম বলেছে। বলল, তোমার জন্যেই যে কেবল একাজ করছি, তা নয়। আমাদেরও আগ্রহ আছে। এটা আমাদের জন্যে আরেকটা কেস।
মানে? টনি বুঝতে পারছে না। ডিটেকটিভের মত কথা বলছ তুমি।
ডিটেকটিভই আমরা। শখের গোয়েন্দা। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দিল কিশোর।
অনেকক্ষণ কার্ডটার দিকে তাকিয়ে রইল টনি। ভুরু কোঁচকাল। তারপর বিড়বিড় করল, এটা কি ভাষা?
দেখি? আরে, বাংলাটা দিয়ে ফেলেছি। এটা আমার মাতৃভাষা।
তার মানে তুমি আমেরিকান নও? অবাক হলো টনি।
বাংলাদেশী। তবে আমেরিকার নাগরিকত্বও আছে আমার। ইংরেজিতে লেখা আরেকটা কার্ড বের করে দিল কিশোর।
সেটাও ঠিক মত পড়তে পারল না টনি। ইনভেসটিগেটরের উচ্চারণ করল নিভেসটিগেটর। শেষে কিশোরের হাতে দিতে দিতে বলল, তুমিই পড়ে শোনাও।
কার্ডের দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করল না কিশোর। জোরে জোরে বলল, কি লেখা আছে।
ও, আরেক দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল টনি। বলল, আমি পড়তে পারি না, তা নয়। আসলে, ডিজলেকজিয়া আছে আমার। ওটা কি জাননা?
জানি, ঘাড় কাত করল রবিন। টনির জন্যে কষ্ট হল তার। এর মানে হল, অক্ষর উল্টোপাল্টা দেখ তুমি। ইটালিতে এই রোগ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। রঙিন লেন্স দিয়ে এখনও চেষ্টা চলছে, সারানোর উপায় খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা।
হ্যাঁ। বাড়ি ফিরলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলেছে আম্মা। সেটা তো বাড়ি যাবার পর। এখানে তো আমি এখন পড়তে পারি না। খুবই কষ্ট হয়। চিঠিও পড়তে পারি না। তাই যোগাযোগ রাখার জন্যে অন্য ব্যবস্থা করেছি। টেপে কথা রেকর্ড করে আদান-প্রদান করি। আম্মা আমাকে টেপ পাঠায়, আমিও আম্মাকে টেপ পাঠাই।