লেকে যদি, বারোর পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল কিশোর। সত্যিই না গিয়ে থাকে ইসাবেল, তাহলে কি করবে? হতে পারে, এই মুহূর্তে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে আমাদের ওপর নজর রাখুছে সে। আলো বেড়েছে। বাড়ছে ক্রমেই। চারপাশে তাকাল সে। আমরা এগোলেই আমাদের পিছু নেবে, চিহ্ন ধরে ধরে। আমাদেরকে জানতে দিতে চায় না। হয়তো, সে-ও যে ওই পেসোর পেছনে লেগেছে।
হাত ওন্টাল মুসা। যদি সেটা করতেই চায়, করবে, আমাদের কিছু করার নেই। চিহ্ন তো আর লুকাতে পারব না।
তা পারব না। শারিকে চলার নির্দেশ দিল কিশোর। তবে একটা সুবিধা আমাদের আছে।
কি?
কাল রাতে ইসাবেলের বারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেছে শারি। আর মিস্টার সাইমন জানিয়েছেন, বারোরা চেনা বারোকে অনেক দূর থেকেও গন্ধ শুকে চিনতে পারে। একজন আরেকজনকে ডাকাডাকি করে জানান দেয়। তাই, ইসাবেলের বারোটা যদি খুব কাছাকাছি চলে আসে, ডাক দেবেই। শারিও জবাব দেবে। মাইল দুয়েকের মধ্যে থাকলেও জেনে যেতে পারব আমরা।
সেদিনকার পথচলা অন্যদিনের চেয়ে কঠিন হল। সব চেয়ে খাড়া আর উঁচু চূড়ায় উঠতে থাকল শারি। ঢালের গভীর সব খাঁজ আর শৈলশিরার ভেতর দিয়ে একেবেঁকে উঠে চলল অনেক উঁচু চূড়াটার দিকে।
একটি বারের জন্যেও থামল না কিংবা ডাকল না ওটা। বার বার পেছনে ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা, কিন্তু ইসাবেল বা তার বারোর ছায়াও চোখে পড়ল।
আরেকবার ধোঁয়া দেখতে পেল ওরা। এক জায়গা থেকে লম্বা হয়ে উড়ছে ঘন সাদা ধোঁয়া। মনে হলো, যে চূড়াটায় উঠছে ওরা, তার ওপাশ থেকে উঠছে ওই ধোঁয়া।
অদ্ভুত তো? মুসা বলল। বনই নেই, আগুন লাগল কিসে? ক্যাকটাস ছাড়া আর কিছুই দেখি না।
হুঁ, মাথা দোলাল কিশোর। পাহাড়ের অন্যপাশে আছে হয়তো।
তিক্ত কণ্ঠে রবিন বলল, এখানে যেন সবাই মিথ্যুক। ডজ মিছে কথা বলে, ইসাবেল মিথ্যে বলে, এখন পাহাড়ও দাবানল লেগেছে বলে ফাঁকি দিয়ে চলেছে আমাদের।
আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। ধোঁয়ার রঙও কেমন আজব! সাধারণ ধোঁয়ার মত নয়।
অনেক ওপরে উড়ছে শিকারি পাখিরাঃ শকুন, ঈগল, চিল। সেদিকে তাকিয়ে রবিন বলল, দাবানল পাখিদের কিছু করতে পারে না। বনের সবাই মরলেও ওরা পালায়। আগুন ছুতেও পারে না ওদের। এদিক থেকে ওরা ভাগ্যবান।
এগিয়ে চলেছে ওরা। রহস্য সমাধানের প্রচন্ড নেশাই রুক্ষ দুর্গম পথে শারির পিছু পিছু টেনে নিয়ে চলেছে কিশোরকে। বিকেলের শুরুতে মুসা আর রবিনকে অনেক পেছনে ফেলে এল ওরা।
এই থাম! আচমকা চিৎকার শোনা গেল। এক পা এগোবে না আর!
থেমে গেল রবিন আর মুসা। মুখ তুলে দেখল ওদের অনেক ওপরে হাত তুলছে কিশোর।
এইবার আস্তে আস্তে এগোও, বলল সে। বারোটাকে অনুসরণ করো।
অবাক হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল দুই সহকারী গোয়েন্দা। তাই তো করছে ওরা। তাহলে কি বলতে চাইছে কিশোর?
ধীরে ধীরে যেন প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে আরম্ভ করল আবার রবিন আর মুসা। শারির একেবারে পেছনেই রয়েছে কিশোর। কোন রহস্যময় কারণে হাত তুলেই রেখেছে সে। বুঝতে পারছে না ওরা।
তারপর থেমে গেল গোয়েন্দাপ্রধান।
আর কাছে এসো না, পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে আবার ভেসে এল কিশোর পাশার কণ্ঠ। কে তোমরা? এখানে কি চাই?
আবার একে অন্যের দিকে তাকাল মুসা আর রবিন। পুরো ব্যাপারটাই কেমন ভূতুড়ে লাগছে এখন ওদের কাছে। হচ্ছেটা কি? পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি ওরা? ওদের মাথায় যেন গোলমাল করে দেয়ার জন্যেই আবার শোনা গেল আমি কিশোর পাশা। তোমার জন্যে খবর নিয়ে এসেছি।
ওর কথা যে কি প্রতিক্রিয়া করছে ওর বন্ধুদের ওপর ভাবল না কিশোর, ভাবার অবকাশও নেই। ওর কাছেও পরিস্থিতিটা বিপজ্জনক। পথের একটা মোড় ঘুরতেই চোখ পড়েছে একটা রাইফেলের নলের ওপর। পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে আছে ওটা।
থাম! আবার আদেশ দিল আগের কণ্ঠটা। এগোবে না আর!
ওই কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিয়েছে শারিকেও। খাড়া হয়ে গেছে কান। মোলায়েম ডাক ছাড়ল একবার।
আবার ধীরে এগোনোর আদেশ হলো। শারিকে নিয়ে এগিয়ে চলল কিশোর। নলের গজখানেক সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। এখনও রাইফেলের নল স্থির হয়ে আছে কিশোরের বুকের দিকে।
পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কিশোরেরই বয়েসী একটা ছেলে। তবে ওর চেয়ে লম্বা। এলোমেলো সোনালি চুল, রোদে পোড়া তামাটে মুখ। পরনে জিনস, পায়ে মেকসিকান বুট, গায়ে ডেনিম জ্যাকেট। রাইফেল নামাল না। নজর শারির দিকে।
শারি, বলল সে। তুই এখানে এলি কি করে?
কেঁপে উঠল বারোর কান। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল ছেলেটার দিকে। তারপর কিশোরের দিকে, তারপর আবার ছেলেটার দিকে। দ্বিধায় পড়ে গেছে।
আদর করে ওর গলা চাপড়ে দিল কিশোর।
আমি নিয়ে এসেছি, শারির হয়ে জবাব দিল সে। কিংবা বলা যায়, আমাকে এনেছে ও। তুমি কি টনি?
জবাব দিল না ছেলেটা। কিশোরের দিকে একই ভাবে রাইফেল তাক করে রেখে সরে এল কিনারে, নিচে তাকাল। তিরিশ গজ নিচে ধীরে ধীরে উঠে আসছে রবিন আর মুসা।
ওরা কারা? ছেলেটার কণ্ঠে সন্দেহ।
অল্প কথায় জানাল কিশোর, ওরা তার বন্ধু, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছে।
তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি আমরা। আবার নাম জিজ্ঞেস করল কিশোর, তোমার নাম টনি, তাই না?