পুরানো চামড়ার জ্যাকেট পরা লোকটার কথা মনে পড়ল কিশোরের। যে ওদেরকে বাসে উঠতে বাধা দিচ্ছিল। লোকটার সঙ্গে তর্ক করার সময় নিশ্চয় মহিলা শুনেছে। বুঝতে পেরেছে ওরা স্প্যানিশ জানে।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বলতে ততটা পারি না। তবে বুঝতে পারি। আস্তে আস্তে বলুন, বুঝব।
গুড। হাঁটু ভাঁজ করে আরাম করে বসল ইসাবেল। টেনে দিল স্কার্ট। পরের পনেরো মিনিট নিচু স্বরে প্রায় একটানা কথা বলে গেল। মাঝে সাঝে একআধটা প্রশ্ন করল কিশোর। ইতিমধ্যে একবার উঠে চলে গিয়েছিল রবিন। কয়েক মিনিট পর ফিরে এসেছে।
তারপর উঠে দাঁড়াল ইসাবেল। তিন গোয়েন্দাও উঠল।
এক এক করে ওদের সঙ্গে হাত মেলাল ইসাবেল। তারপর, যেমন হঠাৎ করে উদয় হয়েছিল, রহস্যময় ভাবে, তেমনি করেই আবার বারো-টাকে টেনে নিয়ে অশ্য হয়ে গেল রাতের অন্ধকারে।
আগুনে কাঠ ফেলল মুসা। কি বুঝলে?
একটা সাংঘাতিক গল্প বলে গেল! মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে বলল কিশোর। রবিন, পঞ্চো ভিলার ব্যাপারে যা যা জানো বলো তো?
আমাকে কি মেকসিকান পাবলিক লাইব্রেরি বলে মনে হচ্ছে?
বাজে কথা রাখ। রকি বীচ থেকেই মেকসিকোর ইতিহাস পড়া শুরু করেছ তুমি। শেষ করোনি এখনও?
করেছি, হাসল রবিন। যেদিন তুমি লেকের পানিতে ডুবে আরেকটা ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছিলে, সেদিনই।
আমিও জানি, শেষ করে ফেলেছ। হাসিটা ফিরিয়ে দিল কিশোর। উনিশ শো ষোলো সালের ব্যাপারে আমার আগ্রহ। পঞ্চো ভিলার কথা কি জানো?
ওই বছর একটা বিরাট বিদ্রোহ হয়ে গিয়েছিল মেকসিকোতে। সেই বিদ্রোহেরই এক বড় নায়ক ছিল পঞ্চো ভিলা। অনেকের ধারণা, আউট-ল ছিল সে, জেসি-জেমসের মত। ব্যক্তিগত একটা সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল। অনেকগুলো লড়াই জিতেছে।
এখানে, সিয়েরা মাদ্রেতেও এসেছিল নাকি?
এসেছিল। তার একটা ঘাঁটি তৈরি করেছিল এখানেই। মরুভূমিতে নেমে গিয়ে ট্রেনের ওপর আক্রমণ চালাত। লুটপাট করে ফিরে এসে আবার লুকিয়ে পড়ত এখানে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। এই কথাটা তাহলে সত্যিই বলেছে ইসাবেল।
তারমানে, তুমি বলতে চাইছ ওর ব্যাপারেই যত আগ্রহ মহিলার? মৃত একজন মানুষের ব্যাপারে?
না, তার ব্যাপারে নয়, কিশোর জবাব দিল। মনে হচ্ছে সিয়েরা মাদ্রের গুপ্তধনের পেছনেই ছুটেছি আমরা, না জেনে, যেটার কথা বহুবার বলেছ তুমি। পঞ্চো ভিলার লুটের মাল। শুনলে না, ইসাবেল বলে গেল, একদিন একটা ট্রেন লুট করে হাজার হাজার ডলার দামের সিলভার পেসো নিয়ে এসেছিল পঞ্চো। এখানে উঠে এসে কোন একটা গুহাটুহায় লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল সে সব পেসো। ইসাবেলের বলে যাওয়া গল্প আবার বলতে লাগল কিশোর। নিজেকেই যেন শোনাচ্ছে। খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এর ভেতরে। একটা ভুল করেছিল পঞ্চো, কিংবা তার দুর্ভাগ্যই বলা যায়, পেসোর সঙ্গে একই গুহায় বারুদ রেখেছিল সে। অসাবধানে দেশলাইয়ের কাঠি ফেলেছিল তার এক সহচর, বিস্ফোরণ ঘটল বারুদে। পর্বতের একটা অংশ ধসে গেল। টন টন পাথরের নিচে চাপা পড়ল পঞ্চোর লুটের মাল, সেই সঙ্গে তার সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশ। পাথর পরিষ্কার করতে শুরু করল পঞ্চো। কিন্তু এই সময় তার শত্রুরা এসে আক্রমণ চালিয়ে বসল পর্বতের অন্য পাশ থেকে পালাতে বাধ্য হলো সে।
এক মুহূর্ত চুপ করে রইল কিশোর।
তারপর, গল্পটা শেষ করল সে। ইসাবেল বলে গেল, শুনলেই তো, মুদ্রাগুলো এখনও সেখানে আছে।
নীরবে কিশোরের কথা শুনছিল মুসা আর রবিন।
ইসাবেল জানল কি করে এসব? রবিনের প্রশ্ন। উঠে চলে যাওয়ায় অনেক কিছুই শোনেনি সে।
ও বলল, তার দাদা নাকি তার সৈন্য দলে ছিল। ও-ই গল্পটা শুনিয়ে গেছে। ওদের পরিবারকে, জবাবটা দিল মুসা।
ডজের কথা কি বলল? জানতে চাইল রবিন। ওর নাম বলতে শুনলাম। বারোটার কথাও কি যেন বলল?
কিশোর বলল, মাস তিনেক আগে নাকি ইসাবেলের এক বন্ধু, টনি নামের এক আমেরিকান তরুণ, এখানে এসেছে। সে আর তার বাবা সোনা খুঁজে বেড়িয়েছে এখানকার পর্বতে। আসলে ওরা খুঁজতে এসেছিল পঞ্চো ভিলার গুহা। ওদের ধারণা, গুহাঁটা খুঁজেও পেয়েছিল ওরা। ইসাবেলকে টনি সে কথাই বলেছে।
চুপ করল কিশোর।
বলো, তাগাদা দিল রবিন। কথার মাঝখানে থামলে কেন? ডজ আর শারি এর মধ্যে এল কিভাবে শুনতে চাই।
টনি যখন লেকে গেল, বলল কিশোর। তার সঙ্গে ছিল একটা ছোট সাদা বারো। গুহার কাছে পেয়েছিল ওটাকে। বাচ্চাটার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলল। যাওয়ার সময় নিয়ে গিয়েছিল ডজের র্যাঞ্চে। তারপর আবার ফিরে গিয়েছিল পর্বতে।
কেন? সাথে করে যখন আনতেই পারল, নিতে পারল না কেন? কেন ফেলে গেল র্যাঞ্চে?
কারণ টনির ভয়, শারি আবার পর্বতে গেলে মরে যাবে। বারোটার চিকিৎসার দরকার ছিল, আর এখানে সব চেয়ে কাছের পশুচিকিৎসক থাকেন লারেটোতে। পিরেটো গিয়ে নিয়ে এসেছিল তাঁকে। বারোটাকে চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলা হলো।
কি হয়েছিল ওর? এটাই যদি অসুস্থ হবে, ডজের র্যাঞ্চ পর্যন্ত গেল কি করে?
চোখে একটা বাজে ধরনের ইনফেকশন হয়েছিল। তাতে প্রায় অন্ধই হয়ে গিয়েছিল বারোটা। ইসাবেলের গল্পের এই জায়গাটায় বিশেষ আগ্রহ কিশোরের। গলা শুনেই যে তাকে চিনেছে বারোটা, তার সঙ্গে ওই চোখের অসুখের কি কোন যোগাযোগ আছে? কেন শারি বুঝতে পারল না, সে টনি নয়, যে তাকে অন্ধত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে বাঁচিয়েছে? অন্ধ হয়ে পর্বতে কোনদিন টিকে থাকতে পারে না কোন বারো। পিরেটোর কথা মনে পড়ল কিশোরের শারি ভাবে, তুমি ওর প্রাণ বাঁচিয়েছ।