হয়তো মেকসিকান মহিলার বারোর পা ভেঙে গেছে, আন্দাজ করল মুসা। কাজেই বোঝা টানার জন্যে আরেকটা দরকার হতেই পারে।
রবিন এই যুক্তি মানতে পারল না। বারোর চরিত্র ভাল করেই জানা আছে মেকসিকানদের। জোর করে যে পিঠে সওয়ার হওয়া যায় না, জানে।
ভাবছি, কিশোর বলল। বারো-টাকে নিজের জন্যেই চেয়েছে কিনা মহিলা। কিংবা অন্য কোন কারণে ওটাকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছে।
তাই? মুসা আর কোন যুক্তি দেখাতে না পেরে চুপ হয়ে গেল।
কিশোরেরও আর কিছু বলার নেই।
আবার শুরু হলো পথচলা।
প্রতি সন্ধ্যায়ই একটা করে জায়গা খুঁজে বের করে শারি, যেখানে আগুন জ্বালানোর জন্যে প্রচুর লাকড়ি আছে, আর খাওয়ার পানির ব্যবস্থা আছে। ওখানেই রাতের জন্যে ক্যাম্প ফেলে ওরা। এর মাঝে ওই মহিলাকে ছাড়া আর কোন মানুষ চোখে পড়েনি ওদের। মাঝে সাঝে একআধটা কুঁড়ে চোখে পড়ে, মাটির দেয়াল আর পাতার ছাউনি, অ্যাডাব বলে ওগুলোকে। সবই দূরে দূরে। ওগুলোতে কেউ থেকে থাকলেও গোয়েন্দাদের চোখে পড়ল না।
দ্বিতীয় দিনে কিশোরের পায়ের পেশী শক্ত হয়ে থাকা সেরে গেছে। আড়ষ্টতা দূর হয়ে একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেছে। হাঁটতে এখন অনেক সহজ লাগে। কোমরের বেল্ট ঢিলে হয়ে গেছে, রওনা দেয়ার সময় যে ছিদ্রটায় ঢুকত বাকলেসের কাটা, এখন তার আগের ছিদ্রটায় ঢোকে।
বাপরে বাপ! বন্ধুদেরকে বলল সে, বারোর পিঠে চাপা-ও কম পরিশ্রম নয়!
সেদিন, একটা শৈলশিরার কাছ দিয়ে চলার সময় সামনে সাদা ধোঁয়া দেখতে পেল ওরা। থেমে গেল। তাকিয়ে রইল সেদিকে।
বিড়বিড় করল রবিন, দাবানল না তো!
হলেও অনেক দূরে, মুসা বলল। আমাদের কাছে আসতে পারবে না।
যদি বাতাস এদিকে না বয়।
এ ব্যাপারে কিশোর কোন মন্তব্য করল না। চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে ধোঁয়ার দিকে।
সেদিন এত বেশি পেছনে পড়ে গেল ডজের ঘোড়া, সন্ধ্যায় তিন গোয়েন্দার এক ঘণ্টা পরে পৌঁছল ক্যাম্পে। খুবই উদ্বিগ্ন ডজ। রাতের খাওয়ার সময় বললেন, একটা দিন বিশ্রাম দিতে হবে ঘোড়াটাকে। নইলে চলতে পারবে না। খোঁড়াও হয়ে যেতে পারে।
খাওয়া শেষ হলে বললেন, তোমরা আমাকে রেখেই এগিয়ে যাও। যত তাড়াতাড়ি পারি তোমাদের কাছে পৌঁছব।
আমাদের খুঁজে পাবেন তো? মুসার গলায় সন্দেহ।
তা পাব। এসব অঞ্চলে চিহ্ন অনুসরণ করে চলা খুব সহজ। দুজন মানুষের জুতো আর একটা বারোর খুরের ছাপ জ্বলজ্বল করবে মাটিতে।
পরদিন সকালে খাবার ভাগ করে দিলেন ডজ। রওনা হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। স্লীপিং ব্যাগের ওপরে আরও কিছু বোঝা, এই যেমন খাবার আর রান্নার সরঞ্জাম, বহন করতে আপত্তি করল না শারি। এবার আর ওটার পিঠে চাপল না কিশোর। হেঁটে চলল। রবিন আর মুসাও রইল সঙ্গে।
সেরাতে ক্যাম্প ফেলার পর প্রচুর কথা বলল ওরা, হাসি-মশকরা করল। ডজ কানের কাছে না থাকায় কথা বলতে পারছে সহজ ভাবে।
রাতে কি খাওয়া যায়, বলো তো? কিশোরকে রান্নার জোগাড় করতে দেখে ঠাট্টা করে বলল রবিন। রাইস আর বীন?
নাহ! জবাব দিল মুসা, বীন আর রাইস।
আসলে, হেসে বলল কিশোর। তোমরা দুজনেই ভুল করলে। রান্না করব বীনস আ লা রাইস। দয়া করে বাসন নিয়ে তৈরি হয়ে যাও।
ডিনারের পর আগুনের কুন্ড ঘিরে বসল তিনজনে। হঠাৎ উত্তেজিত ডাক ছাড়ল শারি। লাফিয়ে উঠল তিনজনে। কান খাড়া।
মুহূর্ত পরেই আগুনের আলোয় একটা বড় বারোকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল গাছের আড়াল থেকে। এল এদিকেই। শারির চেয়ে বয়েস অনেক বেশি। পিঠে জিন নেই। তবে দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে কয়েকটা পোঁটলা।
ওটার পেছন পেছন এল কালো বেণি করা সেই মহিলা।
ডাকাডাকি থামিয়ে দিল শারি। স্বজাতীয়কে দেখে খুশি হয়েছে। দুলকি চালে এগিয়ে গেল। নাক ঘষাঘষি করে স্বাগত জানাল পরস্পরকে।
কাছে এল মেকসিকান মহিলা।
ঘাবড়িও না, হাত নেড়ে স্প্যানিশ ভাষায় বলল সে। এবার বারো চুরি করতে আসিনি। তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমার নাম ইসাবেল। তোমরা কে, জানি। তবে, কথা বলার আগে, আমাকে কিছু খেতে দাও। খুব খিদে পেয়েছে।
এক প্লেট রাইস আর বীন দিল ওকে কিশোর। আগুনের ধারে বসল ইসাবেল। ভাল খিদেই পেয়েছে ওর। সমস্ত খাবার শেষ করার আগে মুখই তুলল না।
বাসে বেশ কিছুটা দূর থেকে ওকে দেখেছে কিশোর। এই প্রথম কাছে থেকে ভালমত দেখার সুযোগ পেল। মহিলা খাচ্ছে, আর সে তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে।
বয়েস চল্লিশ মত হবে। মোটামুটি সুন্দরীই বলা চলে। চেহারাই বলে দিচ্ছে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। পকেট ওয়ালা ঢিলাঢালা একটা উলের স্কার্ট পরেছে। পায়ে মেকসিকান বুট। গায়ে খাটো হাতাওয়ালা একটা ব্লাউজ। চামড়ার রঙ গাঢ় বাদামী, চোখ পিরেটোর মতই কালো। সব মিলিয়ে, কিশোরের মনে হলো, ওই মহিলা ভালর ভাল, মন্দের যম।
খালি বাসনটা সরিয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকাল ইসাবেল। পুরুষের ঘড়ি পরেছে। বেল্টটা ঢিলে। হাত খাড়া করতেই নিচের দিকে নেমে গেল ওটা। তাড়াতাড়ি আবার ওপরের দিকে কব্জির কাছাকাছি তুলে দিল সে।
সময় বেশি নেই, ইসাবেল বলল। লেকের কাছে ফিরে যেতে হবে আমাকে। যতটা তাড়াতাড়ি পারি সংক্ষেপে সব বলে যাচ্ছি তোমাদেরকে। কিশোরের দিকে তাকাল সে। আমি ইংরেজি বলতে পারি না। তবে তোমরা স্প্যানিশ জানো, জানি আমি।