অগ্নিকুন্ডের কাছে ফিরে চলল কিশোর। যাওয়ার সময় তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল রবিন।
স্লীপিং ব্যাগে ঢুকল কিশোর। ঘুমিয়ে পড়ল চারজনে।
অন্ধকার থাকতেই ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। আগুন নিভে গেছে। চোখে ঘুম। প্রথমে বুঝতে পারল না কি কারণে ঘুমটা ভাঙল। তারপর শুনতে পেল শব্দ।
গাধার ডাক। শারি!
একভাবে পড়ে থেকে শক্ত হয়ে গেছে শরীর। কোনমতে বেরিয়ে এল স্লীপিং ব্যাগের ভেতর থেকে। গাছপালার ভেতর দিয়ে ছুটল ঝর্নার দিকে।
বনের ভেতর থেকে বেরিয়েই চোখে পড়ল টর্চের আলো। ওপরে, নিচে, চক্রাকারে নড়ছে আলোক রশ্মি। সেই আলোয় প্রথমে দেখল শুধু বারো-টাকে। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠছে বার বার, সামনের পা দিয়ে লাথি মারার চেষ্টা করছে। প্রচন্ড খেপে গেছে।
ক্ষণিকের জন্যে স্থির হল আলো, চোখে পড়ল মহিলাকে। একহাতে টর্চ, আরেক হাতে বারোর দড়ি, টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। দড়িটা ফাসের মত করে পরিয়ে দিয়েছে শারির গলায়। কিশোরের ভয় হলো, দম না আটকে যায় টানাটানিতে।
আবার চিৎকার করে উঠল শারি। গলায় দড়ি আটকানো থাকায় শব্দটা কেমন ভোঁতা হয়ে গেল। আবার লাফিয়ে উঠল ওটা। সামনের পা দিয়ে লাথি মারার চেষ্টা করল অচেনা আগন্তুককে। একই সঙ্গে টেনে ছোটানোর চেষ্টা করছে গলায় লাগানো দড়ি।
সাপটার কি গতি করেছে, দেখেছে কিশোর। আশঙ্কা হলো মহিলার জন্যে। ওই লাথি যদি মাথায় লাগে, খুলি ভেঙে ঘিলু বেরিয়ে যাবে।
ছেড়ে দিন! চিৎকার করে বলল সে।
ছুটতে শুরু করল কিশোর। চেঁচিয়ে বলতে লাগল, শারি, চুপ কর, শারি! শান্ত হ!
দড়ি ছেড়ে দিয়েছে মহিলা।
টান বন্ধ হয়ে যেতেই আবার চারপায়ের ওপর স্থির হলো শারি। ফিরে তাকাল কিশোরের দিকে। ওটার নাকে হাত বুলিয়ে দিল সে। গলার দড়িটা দেখল। আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে হ্যাচকা টানে ঢিল করে দিল ফাঁসের বন্ধনী। আবার স্বাভাবিক ভাবে দম নিতে পারল শারি। মহিলার দিকে তাকাল কিশোর।
নিভে গেছে টর্চ।
অন্ধকার হয়ে গেছে আবার। ছুটন্ত পায়ের শব্দ কানে এল কিশোরের। পালিয়ে যাচ্ছে মহিলা। ঠিক এই সময় কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল মুসা আর রবিন।
কি হয়েছে? জানতে চাইল রবিন। শারি অমন চেঁচামেচি করল কেন?
ওকে চুরি করতে চেয়েছিল, জানাল কিশোর। এক মহিলা…
খাইছে! মুসা বলে উঠল। আবার সেই সোনালি চুল! তোমাকে যে খুন করতে চেয়েছিল! সে এসেছে বারো চুরি করতে?
না। মাথা নাড়ল কিশোর। টর্চের আলোয় আবছাভাবে দেখেছি তাকে। মুহূর্তের জন্যে। তবে চিনতে অসুবিধে হয়নি। সেই মেকসিকান মহিলা, বাসে যাকে দেখেছি। লাল শাল। কালো বেণি।
১০
পরের দুটো দিন প্রথম দিনের মতই একটানা পথ চল ওরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মাইলের পর মাইল, চলে চলে সিয়েরা মাদ্রের আরও গভীরে ঢুকে যেতে লাগল। এই পর্বতমালার যেন আর শেষ নেই, চলেছে তো চলেছেই। অনেক কষ্টে ঢাল বেয়ে যখন ওঠে, ভাবে ওপারে আর কিছু নেই। কিন্তু চূড়ায় উঠে দেখে ঠিকই মাথা তুলে রেখেছে আরেকটা পাহাড়।
মাঝে উপত্যকা। কোনটা সরু, কোনটা চওড়া। এখানে কয়েক মাইল ধরে চলল পাইনের বন। তারপর, সেই বন পেরিয়ে, আরেকটা ঢাল বেয়ে উঠে গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে এল একসময়, ওপরে রুক্ষ পাথুরে ঢাল প্রায় খাড়া হয়ে উঠে গেছে।
ভাগ্যিস এখন গরমকাল, মুসা বলল। পাথর মাড়িয়ে ওঠার সময় সামনের দিকে ঝুঁকে থাকতে হচ্ছে অনেকখানি, পর্বতের খাড়াইয়ের জন্যে। শীতকাল হলে তুষারেই ডুবে যেতাম।
তাতে মন্দ হত না, রবিন বলল। দরদর করে ঘামছে পরিশ্রমে। কপাল থেকে একফোঁটা গড়িয়ে নামল চোখের পাতায়। এই গরম তো আর লাগত না।
ওদের দিন শুরু হয় এখানে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। সকালে নাস্তা সারে বীন আর চাল সেদ্ধ দিয়ে, দুপুরে লাঞ্চে ঠান্ডা বীন আর চাল সেদ্ধ-সকালে খাওয়ার পর যা বেঁচে যায়, রাতে আবার একই খাবার, গরম গরম, নতুন রান্না করে। মহা বিরক্তিকর। ঘেন্না ধরে গেছে কিশোরের। রবিনের তো এখন দেখলেই বমি আসে। মুসারও আর ভাল লাগছে না।
ফিরে যাওয়ার কথা বলল রবিন আর মুসা। কিন্তু গোঁ ধরে আছে কিশোর। এই রহস্যের শেষ না দেখে সে ছাড়বে না। দেখাই যাক না, কোথায় ওদেরকে নিয়ে যায় শারি। তবে, আর দুচারদিন ওই ভয়াবহ খাবার খেতে হলে তারও মনোবল ভেঙে যাবে।
দিনে তিন-চার বার করে খাওয়ার জন্যে থামে শারি। অন্যদেরকেও থামতে হয় বাধ্য হয়ে। এই থামাটাকে স্বাগতই জানায় তিন গোয়েন্দা। বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া যায়। ডজ তো এক মুহূর্তের জন্যেও থামতে নারাজ। তবে একটা সুবিধে হয় তাঁর এতে। ঘোড়াটাকে নিয়ে অনেক পেছনে পড়ে যান তো, এগিয়ে আসতে পারেন। প্রচুর জই খাওয়ানো হয় ঘোড়াটাকে, তার পরেও প্রতিদিনই একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ছে ওটা। মাঝে মাঝে মাইল খানেক পেছনে পড়ে যায়। রবিন আর মুসার মত পা টেনে টেনে চলে তখন।
এ রকমই একটা বিশ্রামের সময় হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে আছে তিন গোয়েন্দা, ঘাস চিবুচ্ছে শারি। রবিন বলল, ওই মহিলাগুলো কেন এর মধ্যে ঢুকেছে, বুঝতে পারছি না। প্রথমে কিশোরকে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা চালাল সোনালি চুলওয়ালা এক মহিলা, তারপর কালো বেনি এসে চুরি করার চেষ্টা করল বারোটাকে।