সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা কমে গেল। শার্টের ওপরে সোয়েটার পরে নিল তিন গোয়েন্দা। লাকড়ি জোগাড় করে চমৎকার একটা আগুনের কুন্ড বানিয়ে ফেলল মুসা। তারপর ঘোড়া থেকে মালপত্র নামাতে সাহায্য করল ডজকে।
শারির পিঠ থেকেও বোঝা নামিয়ে ফেলল কিশোর। জিন খুলে নিল। ঘাসপাতা খাওয়াল, ঝর্নার ধারে নিয়ে গেল পানি খাওয়াতে। তারপর সে আর রবিন মিলে রান্না করতে বসল। বড় একটা পাত্রে চাল আর বীন নিয়ে সিদ্ধ করে নিল।
এই জিনিস খাওয়া যায়! বিরস দৃষ্টিতে তাকাল ওগুলোর দিকে কিশোর। কিন্তু কি আর করা। বেঁচে থাকতে হলে খেতেই হবে। এই খাবারে দুজন লোক কিছুই মনে করল না। একজন ডজ, তার অভ্যাস আছে, আরেকজন মুসা, যার কোন খাবারেই অরুচি নেই।
খেতে খেতে ভাবছে কিশোর—আর কোন সন্দেহ নেই, সাংঘাতিক রহস্যময় একটা কেস পেয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। সমাধান করতে ভালই লাগবে। রহস্যটার কথা ভাবতে ভাবতে কোন দিক দিয়ে যে চাল আর বীন সেদ্ধ গিলে শেষ করে ফেলল সে, খেয়ালই রইল না।
খাওয়া শেষ করে জুতো খুলে ফেলল রবিন। পায়ের পাতায় হাত বোলাতে লাগল। ঢাল বেয়ে উঠতে গিয়ে ব্যথা হয়ে গেছে। ফোসকাও পড়েছে।
আর কতদূর যেতে হবে? ডজকে জিজ্ঞেস করল সে।
তীক্ষ্ণ হলো ডজের দৃষ্টি। কেন, তোমার ভাল্লাগছে না?
রবিনের দৃষ্টি আরও বেশি তীক্ষ্ণ হলো। এভাবে এগোনোর কথা কিন্তু ছিল না। ছিল, শারির খুরের ব্যবস্থা করার কথা। ওকে পাহাড়ে ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার কথা। এমন কোথাও যেখানে ওর খুর ঠিক থাকবে। এখানে প্রচুর, পাথর আর পাহাড় আছে। জায়গাটা ভালও লাগছে মনে হয় ওর। তাহলে আর দেরি কেন?
রূঢ় কণ্ঠে কথাগুলো বলল সে। ডজের মিথ্যে বলা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছে। লোকটাকে বুঝিয়ে দিতে চায় ওরা কচি থােকা নয় যে এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে আর অনর্গল মিথ্যে বলে বলে ধোকা দেবেন। বোঝাতে চায়, শারির খুর নিয়ে যে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই ডজের, এটা বুঝে গেছে ওরা।
হ্যাঁ, রবিনের কথার প্রতিধ্বনি করল যেন মুসা, এটা শারির জন্যে চমৎকার জায়গা। পাহাড়ের ঢালে কিছু কিছু জায়গা তো দেখলাম লোহা ঘষার উখার চেয়েও ধার। এখানেই ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন?
সাথে সাথে জবাব দিলেন না ডজ। কয়েকটা ডাল ছুঁড়ে দিলেন আগুনে। বারোটা নিজেই বুঝিয়ে দেবে কোথায় ওকে ছাড়তে হবে। যেখান থেকে এসেছে সেখানেই চলেছে। সেখানে পৌঁছলেই থামবে।
হোম, সুইট হোম, আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর। বাড়ির জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে ও, একথা কেন মনে হচ্ছে আপনার?
বলা কঠিন, অধৈর্য কণ্ঠে জবাব দিলেন ডজ। কখনও কখনও বুনো বারোরা বাড়ির কাছাকাছিই থাকতে চায় সব সময়। কেন, কে জানে!
এখনও যে মিথ্যে বলছেন ডজ, বুঝতে পারছে কিশোর। রবিন আর মুসাও পারছে।
তাহলে বাড়ি থেকে অতদূরে র্যাঞ্চে গিয়ে উঠল কেন? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল মুসা।
বুনো বারোরা অনেক সময়ই দলছুট হয়ে দূরে চলে যায়। তারপর আবার একই কথা বললেন ডজ, কেন, কে জানে!
এটাও মিথ্যে কথা, ভাবছে কিশোর। দলছুট হয়ে নিছক খেয়ালের বশে র্যাঞ্চে গিয়ে হাজির হয়েছে বারো, কিছুতেই বিশ্বাস করে না সে। কেউ ওকে নিয়ে গিয়েছিল ওখানে। এমন কেউ, যাকে বিশ্বাস করে, পছন্দ করে শারি। সেই লোকের সঙ্গে সঙ্গেই চলে গিয়েছিল। হয়তো ওর প্রাণ বাঁচিয়েছিল ওই লোক এবং যার কণ্ঠ কিশোরের মত।
ঘাস খেতে খেতে আগুনের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে বারো-টা। ওটার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি বাড়ছে ডজের। শেষে আর থাকতে না পেরে কিশোরকে বললেন, অনেক খেয়েছে। এবার বেঁধে ফেল। রাতে যেন ছুটতে না পারে। জোর করে হাসি ফোটালেন চেহারায়। নইলে আবার কি খেয়াল হয় কে জানে! র্যাঞ্চে ফিরে চলে যেতে পারে। বারোর কথা কিছুই বলা যায় না।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। শারির পিঠে চড়ার সময় বুঝতে পারেনি, কতটা ধকল গেছে, এখন পারছে। এত শক্ত হয়ে গেছে পায়ের পেশী, ঠিকমত দাঁড়াতেই পারছে না। পায়ের পাতায় যেন কাঁটা বিঁধেছে, এরকম ভঙ্গিতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জানোয়ারটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। আদর করে চাপড় দিল পিঠে। বলল, দূরে যাসনে। আমার কাছাকাছি থাকবি।
ওসব বলে লাভ হবে না, ডজ সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। গাধা গাধাই। ওটাকে বেঁধে ফেল, গাছের সঙ্গে।
ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। ডজের মুখোমুখি। মাথা নাড়ল। না। রাতে পিপাসা লাগতে পারে ওর। পানি খেতে যেতে পারবে না বেঁধে রাখলে।
পানি আর কত খাবে? যা খাওয়ার খেয়েছে।
রাখঢাকের সময় শেষ হয়ে এসেছে। কাজেই নমনীয় হলো না কিশোর। বেঁধে রাখতে চাইলে আপনি যান। দেখুন ছুঁতে দেয় কিনা।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চোখে চোখে তাকিয়ে রইল দুজনে। চলার সময় বস হয়ে যায় বারোটা, কিন্তু এখন বস্ হলো কিশোর। সেটাই বুঝিয়ে দিতে চাইল। সে যা বলবে তাই হবে।
বেশ, অবশেষে নরম হলেন ডজ। হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে ঢুকলেন স্লীপিং ব্যাগের ভেতরে। আমার বিশ্বাস, যতক্ষণ তুমি আছ, কাছাকাছিই থাকবে বারোটা।
কেন? কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার এ বিশ্বাস হলো কেন? আমার প্রতি কেন এত আকর্ষণ গাধাটার?
কুইয়েন সাবে! মেকসিকানদের ভাষায়ই বললাম। কাত হয়ে শুলেন ডজ। চোখ মুদল। মানে করে দিল কথাটার, কে জানে!