কিশোর আন্দাজ করল, আবার খেতে চায় শারি। শরীরটা ঢিল করে দিয়ে লাফিয়ে নামল পিঠ থেকে। তার নিজের বিশ্রামের জন্যেও জায়গাটা চমৎকার। ক্যাকটাসের পাশে একটা চ্যাপ্টা মসৃণ পাথর দেখতে পেল। ওটার দিকে এগোতে গেল সে।
সঙ্গে সঙ্গে গলা বাড়িয়ে দিল শারি, পথ আটকাল কিশোরের। পাশ কাটিয়ে সে যখন এগোনোর চেষ্টা করল, তার শার্টের ঢোলা জায়গায় কামড়ে ধরল ওটা।
রেগেই গেল কিশোর। এই, কি হয়েছে? কি করতে চাস? ঘাস খেতে কি মানা করেছি নাকি তোকে! টেনে শার্টটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে। কিন্তু ধরে রাখল শারি।
হাল ছেড়ে দিল কিশোর। বারোর সঙ্গে পারবে না। ওটা যখন কিছু করবে বলে গো ধরে, কারও সাধ্য নেই সেকাজ থেকে বিরত করে। আপাতত যেখানে রয়েছে সেখানেই থাকতে চাইছে। কিশোরকেও থাকতে বলছে। কাজেই নড়ানো সম্ভব না।
যখন ওটার ঘাড়ে চাপড় দিয়ে আদর করল কিশোর, তখন ছাড়ল শার্ট। কিন্তু পথ ছাড়ল না। যেতে দিতে চায় না কিশোরকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ক্যাকটাসের জটলাটার দিকে।
এই সময় বারোটার কানের দিকে চোখ পড়ল কিশোরের।
ঘাড়ের সঙ্গে একেবারে লেপটে রয়েছে।
ঘাড়ের বড় বড় রোমগুলো লেপটে নেই, সাধারণত যেভাবে থাকে। দাঁড়িয়ে গেছে। ভয়ে কাঁপছে থিরথির করে।
৯
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। চোখ ক্যাকটাসের দিকে।
হাঁচড়ে-পাচড়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল রবিন আর মুসা।
কি হয়েছে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
বুঝতে পারছি না। কিছু দেখে ভয় পেয়েছে শারি।
পা বাড়াতে গেল রবিন। ধরে ফেলল তাকে মুসা। বারোর ঘাড়ের রোম যে দাঁড়িয়ে গেছে সেটা সে-ও লক্ষ্য করেছে। দেখি, কি করে ও।
কিছুই করল না শারি। তাকিয়েই রয়েছে ক্যাকটাসের দিকে। পেছনে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে এল ডজের ঘোড়া। কি হয়েছে?
শব্দটা কানে এল এই সময়। মৃদু একটা খড়খড়। ওদের কানে শব্দ পৌঁছার আগেই জেনে ফেলেছে বারোটা, সামনে মারাত্মক বিপদ।
শব্দটা আসছে ক্যাকটাসের পেছনের একটা পাথরের ওপাশ থেকে। কিসে করছে? আবার হলো শব্দ, আরও জোরাল। এবার আর খড়খড় নয়, অনেকটা মৌমাছির গুঞ্জনের মত।
ঘোড়াটার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন ডজ। জোরে শ্বাস টানলেন একবার। হাত বাড়ালেন রাইফেলের দিকে। র্যাটল স্নেক! ক্যাকটাসের পেছনেই! ভয় দেখিয়ে খোলা জায়গায় বের করে আনতে হবে, যাতে গুলি করতে পারি।
পাথর কুড়িয়ে নিল তিন গোয়েন্দা। ছোঁড়ার জন্যে তৈরি হলো। ক্যাকটাসের দিকে রাইফেল তুলে ধরলেন ডজ।
মার! বলে উঠল মুসা। একই সঙ্গে পাথর ছুঁড়ল তিনজনে। থেমে গেল গুঞ্জন। তবে নীরব হলো না।
জোরাল খটাখট আওয়াজ করে ক্যাকটাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সাপটা। চার ফুট লম্বা। চ্যাপ্টা মাথাটা ওপরে তোলা। সাংঘাতিক দ্রুত গতি। শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে পলক ফেলতে না ফেলতে ছুটে আসছে।
লাফিয়ে পেছনে সরে এল তিন গোয়েন্দা।
গুলি করলেন ডজ।
মনে হলো, লাগেনি। লাফিয়ে একপাশে সরে গিয়ে আবার আসতে লাগল।
তাকিয়ে রয়েছে যেন রবিন। সোজা তারই দিকে আসছে সাপটা। গোল গোল চোখ, লম্বা জিভটা দ্রুত বেরোচ্ছে আর ঢুকছে, লেজটা তুলে ধরা। লেজের ডগায় অনেকগুলো হাড় বোতামের মত একটার ওপর আরেকটা আলগা ভাবে বসানো, বাড়ি লেগে লেগে ওই অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। সরে যেতে চাইছে, কিন্তু পা উঠছে না। সম্মােহিত করে ফেলেছে যেন তাকে সাপটা।
রাইফেলের বোন্ট টানার শব্দ হলো। রাইফেল তুললেন ডজ।
কিন্তু ট্রিগার টেপার সুযোগ পেলেন না। নলের সামনে রয়েছে শারি, ওটার গায়ে গুলি লাগতে পারে।
চ্যাপ্টা হয়ে একেবারে ঘাড়ের সঙ্গে মিশে গেছে যেন বারোর কান। ঘুরছে। সাপটা যতই এগিয়ে আসছে, চঞ্চল হয়ে উঠছে ওটা। কিন্তু রবিনের মতই যেন সম্মােহিত হয়ে গেছে।
ফনা আরও উঁচু হল সাপটার। ছোবল মারার জন্যে প্রস্তুত।
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে গেল হঠাৎ শারি। পেছনের দুই পা তুলে লাথি চালাল।
সাপের শরীরের মাঝামাঝি জায়গায় আঘাত হানল এক পায়ের লাথি। উড়ে গিয়ে বিশ ফুট নিচে পাথরের ওপর পড়ল ওটা। একটা সেকেন্ড নিথর হয়ে পড়ে বইল, যেন মরে গেছে। রবিনও তাই ভেবেছিল। কিন্তু ওদেরকে অবাক করে দিয়ে নড়ে উঠল ওটা। পিছলে গিয়ে ঢুকে পড়ল পাথরের ফাঁকে।
স্যাডল হোলস্টারে রাইফেলটা ঢুকিয়ে রাখলেন ডজ।
কেউ কথা বলল না। সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে। তারপর, নীরবে আবার পা বাড়াল।
সামনের দিকে এগোল না আর শারি। উপরেও উঠল না। সমতল জায়গাটাকে ঘুরে এগোল। আবার জঙ্গল চোখে পড়ল কিশোরের। তাড়াহুড়ো করে সেদিকে এগিয়ে চলল বারো-টা। মূল পথ থেকে সরে যাচ্ছে, কিন্তু থামানোর চেষ্টা করল না কিশোর। যেদিকে খুশি যাক। ডজ বলেছেন ওটাকে ওটার ইচ্ছের ওপরই ছেড়ে দিতে।
বনে ঢুকে কিছুদূর এগিয়ে থেমে গেল শারি। ওটার গলা চুলকে দিল কিশোর।
আর কিছু বলব না তোকে, বলল সে। তোর ইচ্ছে মত চলবি। বুঝে গেছি, এখানে আমার চেয়ে তোর বুদ্ধি অনেক বেশি।
মুসা আর রবিন এল। ওদের পেছনে এলেন ডজ। চারপাশে তাকিয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, রাতে ক্যাম্প ফেলার জন্যে চমৎকার জায়গা বেছেছে বারো। প্রচুর লাকড়ি আছে, সবুজ ঘাস আছে। কাছেই একটা সুন্দর ঝর্না, কিশোরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল সেখানে।