গেট থেকে বেরিয়ে এসে ফিরে তাকাল কিশোর। দাঁড়িয়ে রয়েছে পিরেটো কিশোর তাকাতে হাত তুলল। কি বোঝাতে চাইল? সাবধান করল? না গুডবাই?
ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে পাহাড়ী পথ। চার-পাঁচ মাইলের বেশি গতি বাড়াচ্ছে না ডজ। যাতে শারির আসতে অসুবিধে না হয়।
বালি আর পাথর বিছানো রয়েছে পথ জুড়ে। এক ঘণ্টা চলার পর সরু হয় এল পথ। ঢুকে গেল পাইন বনের ভেতরে।
আরও এক ঘণ্টা পর জীপ থামালেন ডজ, ইঞ্জিন ঠান্ডা করার জন্যে। পানি পড়ার শব্দ কানে আসছে। দড়ি ছোটানোর জন্যে টানাটানি শুরু করল শারি।
মনে হয় পানি খেতে চাইছে, কিশোর বলল। আমি যাচ্ছি ওর সঙ্গে। নই পালাতে পারে।
বারোটাই ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল ছোট একটা পার্বত্য নালার কাছে। টলটলে পরিষ্কার পানি। দেখার পর কিশোরেরও খেতে ইচ্ছে করল। পিপাসা অবশ্য আগেই পেয়েছে। পিরেটোর কাছে শুনেছে, সিয়েরা মাদ্রের ঝর্না থেকে পানি খেতে মানা নেই, তবে বদ্ধ জলাশয় থেকে খাওয়া একদমই উচিত নয়। হাঁটু গেড়ে বসে আঁজলা ভরে পানি তুলে খেতে শুরু করল সে। তার পাশেই মুখ নামিয়ে খাচ্ছে শারি।
পানি খাওয়া শেষ করে পাতা চিবুতে লাগল বারো। ওর জন্যে সঙ্গে করে কিছু আনা হয়নি। ঘোড়ার মত বেছে খায় না বারো, কাজেই ওগুলোর জন্যে তেমন ভাবনা নেই। ছাগলের মত যা খুশি খেতে পারে। পিরেটো একথা বলেছে, কিশোরকে। ঠিকই বলেছে। এখন তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
মিনিট কয়েক ঘাস আর লতাপাতা খেল শারি। এই সময় শোনা গেল ডজের ডাক। অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। বারোটাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে টানতে লাগ কিশোর। চেঁচিয়ে বলল, আয়, আয়, দেরি হয়ে গেল! কানেই তুলল না ওটা পেট না ভরা পর্যন্ত খেয়েই চলল।
রেগে গেলেন ডজ, কিন্তু কিছু বলারও নেই। বারোটা আসতে না চাই কিশোর কি করবে? সমস্ত রাগ যেন গিয়ে পড়ল ইঞ্জিনের ওপর। স্টার্ট দিয়ে অযথাই এক্সিলারেটর বাড়িয়ে গোঁ গোঁ করালেন কয়েক সেকেন্ড। খাবার বানিয়ে প্যাকেট করে দিয়েছিল পিরেটো। সেগুলো দিয়ে লাঞ্চ করেছে সবাই। রবিন, মুসা আর ডজ খেয়েছেন। কিশোর কেবল বাকি। তার স্যান্ডউইচগুলো নিয়ে বড় বড় কামড় দিয়ে খেতে শুরু করল। জীপ ততক্ষণে চলতে আরম্ভ করেছে। একহাতে গাধার দড়ি ধরে রেখে আরেক হাতে খাচ্ছে কিশোর।
আরও ঘণ্টা তিনেক চলার পর বালিতে ঢাকা সরু পথও অদৃশ্য হয়ে গেল।
এখানে জীপ রেখে যেতে হবে আমাদের, ডজ বললেন।
মালপত্র নামাতে লাগল ওরা। বাক্স থেকে ঘোড়াটাকে নামিয়ে আনল মুসা। হর্সবক্স সহ জীপটাকে পাইন বনের ভেতরে নিয়ে গেলেন ডজ। ডালপাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো দুটো গাড়িকেই। ভারি ভারি বোঝাগুলো তোলা হলো ঘোড়ার পিঠে। শারির কাঁধে স্লীপিং ব্যাগগুলো তুলে দিয়ে বেঁধে ফেলল কিশোর।
তুমি আগে আগে যাও, কিশোরকে বললেন ডজ। বারোটাকে ঢিল দিয়ে দাও। ও যেদিকে যায় সেদিকেই যাবে। ওটাই পথ দেখাক।
চট করে বন্ধুদের দিকে তাকাল একবার কিশোর।
আবার শুরু হলো চলা। শারির পিঠে বসল কিশোর। যার যার ব্যাকপ্যাক পিঠে নিয়ে হেঁটে চলল রবিন আর মুসা। সবার পেছনে ঘোড়ায় চেপে আসছেন ডজ।
কয়েক মিনিট চলার পরেই বুঝে গেল কিশোর, গাধার পিঠে চেপে যাওয়াটা কতটা কষ্টকর। একটা মুহূর্তের জন্যে অসতর্ক হতে পারছে না।
দেখতে দেখতে গাছপালার মাথার ওপরে উঠে এল দলটা। ঢালের গায়ে এখন আর গাছ নেই, বন নিচে পড়ছে ক্রমশ। খাঁড়া পাথুরে ঢালে হাঁটতে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে রবিন আর মুসার। বার বার পা পিছলে যাচ্ছে আলগা পাথরে।
শারির কিছুই হচ্ছে না। পিরেটো বলেছে, পাহাড়ি ছাগলের মতই পাহাড় বাইতে পারে বাবোরা। তা তো হলো, কিন্তু কিশোর তো আর ছাগল নয়, বারোও নয়, কাজেই পিঠ থেকে পড়ে যাওয়া এড়ানোর জন্যে শারির গলা জড়িয়ে ধরে রাখতে হলো ওকে। ছেড়ে দিলে গড়িয়ে পড়ে যাবে পিঠ থেকে এবং তারমানে পাহাড় থেকেও গড়িয়ে পড়া।
কষ্ট হচ্ছে কিশোরের, তবে ডজের চেয়ে কম। বারোর মত পাহাড় বাওয়ায় দক্ষ নয় ঘোড়াটা। ঠিকমত ঠিক জায়গায় পা ফেলতে পারছে না। মাঝে মাঝেই এগোতে না পেরে থেমে যাচ্ছে। পিঠ থেকে নেমে তখন এগোনোর জন্যে ওটাকে ঠেলতে হচ্ছে ডজকে। কখনও বা লাগাম ধরে টেনে কোন উঁচু পাথর পার করিয়ে আনছেন। ফলে সময় নষ্ট হচ্ছে। খানিক পরেই দেখা গেল মুসা আর রবিনের প্রায় আধ মাইল পেছনে পড়ে গেলেন তিনি।
সবার আগে রয়েছে কিশোর। আর সবাই অনেক পেছনে। ওদেরকে এগিয়ে আসার সময় দেয়ার জন্যে শারিকে থামতে বলল সে, হয়া! হুয়া!
শুনতেই পেল না যেন বারোটা।
তখন ওটার কানের কাছে চিৎকার করে বলল কিশোর, হয়া! হুয়া! থামার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেই বারোটার। অনেক দিন পর পাহাড়ে চড়ার সুযোগ পেয়েছে বোধহয়, এগিয়ে চলেছে মহা আনন্দে। কারও জন্যে অপেক্ষা করার প্রয়োজনই বোধ করছে না। লাগাম টেনে বোঝাতে চাইল কিশোর, ওর হুকুম মেনে চলা উচিত। পাত্তাই দিল না বারো।
তারপর কিশোর যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, এই সময় হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়াল।
এতই আচমকা, আরেকটু হলেই পিঠ থেকে পড়ে যেত কিশোর। যেন ব্রেক কষে দাঁড়িয়েছে জানোয়ারটা। একটা সমতল জায়গার কিনারে এসে পৌঁছেছে। পাথরের ছড়াছড়ি, তার ফাঁকে ফাঁকে গজিয়ে উঠেছে ঘাস। ঠিক সামনেই মাথা তুলেছে একগুচ্ছ ক্যাকটাস।