দারুণ, মুসা, কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন। একটা কাজ করেছ। হলিউডের পরিচালকরা ওরকম একটা দৃশ্যের শট নিতে পারলে বর্তে যেত।
হাসল মুসা। আমি তো ভেবেছিলাম দ্য ট্রেজার অভ দ্য সিয়েরা মাদ্রের শুটিং হবে, তুমি বানিয়ে দিলে জজ! মুশকিল হলো, এই কথাটা কিছুতেই শোনানো যাবে না মেরিচাচীকে। বাহবা নিতে গিয়ে বকা খেয়ে মরব, কেন তোমাকে একলা যেতে দিলাম এই জন্যে।
কিশোরও হাসল। এই না হলে বন্ধু! বসে পড়ে ভেজা জুতো আর মোজা টেনে টেনে খুলছে সে। পানিতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড ছিল, তাতেই নীল হয়ে গেছে ঠান্ডায়। ভাগ্যিস সাঁতরে তীরে পৌঁছার চেষ্টা করেনি।
রিলের হাতল ঘুরিয়ে সুতোটা গুটাতে লাগল মুসা। রবিনকে বলতে লাগল কিশোর, কি ঘটেছে। মুসাও শুনছে ওর কথা। টেলিফোনে অচেনা কণ্ঠ। তারপর দাঁড় ভেঙে যাওয়া। কি যেন একটা রহস্য আছে বলে মনে হচ্ছে তার।
জিজ্ঞেস করল মুসা, স্রেফ ভেঙে গেল?
গেল। এতটাই পচা ছিল। ইচ্ছে করেই হয়তো রেখেছে ওই জিনিস। ডান্ডার মাথা পরীক্ষা করে দেখে বলল কিশোর, যাতে জোরে চাপ লাগলেই ভেঙে যায়। আমাকে খুন করতে চেয়েছে। এমন কায়দা করেছে, সবাই যাতে মনে করে ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা।
রবিনের দিকে তাকাল সে। কাউকে দেখেছ লেকের পাড়ে?
নৌকার কিনারে বসেছে রবিন। মাথা ঝাকাল। দেখেছি। অন্য পাড়ে। একজন মহিলা। একপলক দেখলাম, তারপরেই হারিয়ে গেল বনের ভেতরে। মনে হচ্ছিল, তোমার ওপর নজর রেখেছিল সে। তুমি তখন প্রপাতের দিকে চলেছ।
দেখতে কেমন? জিজ্ঞেস করল মুসা। বলেই মাথা নাড়ল, না না, বলার দরকার নেই, বুঝতেই পারছি। সেই মেকসিকান মহিলা। লাল শাল পরেছিল যে।
মাথা নাড়ল রবিন। না। ও নয়। আমার কাছে একে আমেরিকান মনে হয়েছে। নীল জিনস পরনে, গায়ে হালকা রঙের শার্ট আর…
আর সোনালি চুল, বলে দিল কিশোর। অবাক হলো রবিন। অতি-মানবিক কোন ক্ষমতা আছে নাকি তোমার!
৮
পরদিন সকালে পর্বতে যাওয়ার জন্যে তৈরি হলো তিন গোয়েন্দা।
জীপের পেছনে বেঁধে লারেটো থেকে একটা হর্স বক্স নিয়ে এসেছেন ডজ। চাকা লাগানো, চারপাশে কাঠের বেড়া দেয়া একটা ঠেলাগাড়ির মত। মাঠ থেকে একটা ঘোড়া ধরে নিয়ে এসেছে পিরেটো। ওটার পিঠে জিন বাঁধতে ওকে সাহায্য করছে মুসা। ঘোড়াটা খুব শান্ত। মুসা যখন ওটাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল ট্রেলার হোমে তোলার জন্যে, একটুও বাধা দিল না।
ওটার সঙ্গে রইল সে, পরিচিত হওয়ার জন্যে। গলা চাপড়ে আদর করল, ডলে উলে চকচকে করে দিতে লাগল চামড়া। পিরেটো আর কিশোর এই সময় গেল শারিকে আনার জন্যে। মেকসিকান লোকটার সঙ্গে একা থাকার সুযোগ পেয়ে খুশিই হলো গোয়েন্দাপ্রধান। সাবধানী পিরেটোর কাছ থেকে কোনভাবে যদি কিছু তথ্য জোগাড় করতে পারে।
লেকের ধারে ওই যে নৌকায় উঠেছিলাম আমি, জিজ্ঞেস করল কিশোর। ওটা কি সব সময়ই ওখানে থাকে?
নৌকা তাহলে আর কোথায় রাখবে? রান্নাঘরে?
ওটা কার?
এই র্যাঞ্চের।
কেউ কি ব্যবহার করে?
মাঝেসাঝে।
কি কাজে?
মাছ ধরার কাজে।
ভীষণ চালাক লোকটা। এভাবে ওর কাছ থেকে তথ্য জোগাড় করতে পারবে বলে মনে হলো না কিশোরের। তবে একটা কথা জানতে হবে যে করেই হোক।
লেকের অপর পাড়ে সোনালি চুলওয়ালা যে আমেরিকান মহিলাকে দেখেছে, নিশ্চয় সে-ই ফোন করেছিল ওকে, সন্দেহ নেই। হতে পারে ওই মহিলাই পচা দাঁড়টা রেখেছিল। কিন্তু তাহলে ওই দাঁড় দিয়ে নৌকাটাকে এপাড়ে আনল কি করে? আর সে নিজেই বা ফিরে গেল কিভাবে?
ওপাড়ের গায়ে যেতে চাইলে, চেষ্টা চালিয়ে গেল কিশোর, কিভাবে যাবেন?
হেঁটে।
কিন্তু লেক তো অনেক গভীর। হাঁটা যায়?
ওদিকটায় অত গভীর নয়। নদীর উজানের দিকে দেখাল পিরেটো। তাছাড়া বড় বড় পাথর আছে, ওগুলোর ওপর দিয়েই হাঁটা যায়।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। জবাব এটাই হবে। ওই পাথরের ওপর দিয়েই হেঁটে পার হয়ে গেছে আমেরিকান মহিলাটা। আর রাতের বেলা বারান্দায় ওর সঙ্গেই হয়তো কথা বলেছিল পিরেটো। তারমানে ওকে চেনে সে।
গায়ে আপনার কোন বন্ধু আছে নাকি?
একজনকে চিনি। বার আর ক্যানটিনার মালিক, আমার খালাত ভাই।
কোন আমেরিকানকে চেনেন না? সোনালি চুলওয়ালা একজন মহিলা?
শারি যে মাঠে থাকে ওটার গেটের কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। ফিরে তাকাল পিরেটো। বোকামি করছে ও। সে কথা বলেছিও ওকে। ভীষণ ভয় পেয়েছে। ভয় পেলে লোকে উল্টোপাল্টা কাজ করে বসে। তোমার যে কোন ক্ষতি হয়নি, তাতে আমি খুশি। কিন্তু…
কিশোরের কাঁধে হাত রাখল পিরেটো। পর্বতে গিয়ে সাবধানে থাকবে। সতর্ক করে দিল সে। ভয়ানক বিপদের জায়গা।
কিশোরকে দেখে উত্তেজিত হয়ে ছুটে আসছে শারি।
দরজা খুলে দেয়া হলো। কিশোরের গায়ে নাক ঘষতে লাগল জানোয়ারটা।
ওটার কানের পেছনটা চুলকে দিল কিশোর। ও-যাই করুক, চুপ করে থাক বারোটা। কিন্তু আর কাউকে কাছেই ঘেঁষতে দেয় না। পিরেটোকেও না। দূর দাঁড়িয়ে আছে সে। কিশোরকে বলল, জিন আর লাগাম ছাড়া চড়তে পারবে। কিন্তু পরানোটাই হলো মুশকিল। যতই পছন্দ করুক তোমাকে, যেই জিন পরাবে মাটিতে গড়াতে শুরু করবে, পিঠ থেকে ওটা খুলে না ফেলে আর থামবে না।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল কিশোরের। তাই নাকি?
জীপটা রসদপত্র দিয়ে প্রায় ভরে ফেলেছেন ডজ। বীন আর চালের বস্তা, চিনি, কফি ও প্রয়োজনীয় আরও খাবার নিয়েছেন। ঘোড়ার জন্যে নিয়েছে জই। স্লীপিং ব্যাগ আর রাইফেল নিয়েছেন। মালপত্রের ফাঁকে জায়গা নেই বললেই চলে ওখানেই কোনমতে গাদাগাদি করে বসেছে মুসা আর রবিন। কিশোর বসেছে ডজের পাশে। হাতে লম্বা একটা দড়ি, এক মাথা বাঁধা রয়েছে গাধার গলায় জীপের পেছন পেছন আসছে বারোটা।