স্রোতের টানে লেকের মাঝামাঝি চলে এসেছে নৌকা, দুই তীরই এখন সমান দূরত্বে। স্রোতের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ভাঙা বৈঠা দিয়ে নৌকা বাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালাল কিশোর। লাভ হচ্ছে না।
সাহায্যের জন্যে চিৎকার করবে কিনা ভাবল। কিন্তু তাতেই বা কি লাভ? তার চিৎকার পিরেটো কিংবা রবিনের কানে গেলেও আরেকটা নৌকা ছাড়া ওরা এসে সাহায্য করতে পারবে না তাকে।
ছুটে চলেছে নৌকা। লেক বেয়ে গিয়ে পড়বে নদীতে।
সাঁতার ভাল জানে কিশোর। ডাইভ দিয়ে পড়ে ডুব সাঁতার দিয়ে তীরে ওঠার চেষ্টা করতে পারে। মনে পড়ল পিরেটোর হুঁশিয়ারি। পানিতে গোসল করার চেষ্টা কোরো না, কয়েক মিনিটের বেশি এই পানিতে টিকতে পারবে না কোন মানুষ। পানিতে হাত ডুবিয়ে দিয়ে বুঝতে পারল কিশোর, মিথ্যে বলেনি মেকসিকান লোকটা। বরফের মত ঠান্ডা পানি।
যতক্ষণ নৌকায় রয়েছে ততক্ষণ জমে মরার ভয় অন্তত নেই। স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে নদীতে। কতক্ষণ লাগবে যেতে?
গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য গ্রামটার কথা ভাবল সে। হয়তো ওখানে কারও নৌকা আছে।
আর কোন উপায় না পেয়ে শেষে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকারই শুরু করল কিশোর। স্প্যানিশ ভাষায়। কিন্তু দুপুরের এই প্রচন্ড গরমের সময় লেকের তীর নির্জন। একটা মানুষকেও চোখে পড়ল না। ঘেউ ঘেউ করে উঠল একটা কুকুর। কোন মানুষ সাড়া দিল না।
মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল কিশোর। বুদ্ধি একটা বের করতে হবে। নদীতে হয়তো এমন জায়গা আছে, যেখানে পানির গভীরতা কম। তাহলে হয়তো কোনমতে উঠে যেতে পারবে তীরে।
এখান থেকে বোঝা যাবে না পানি কতটা গভীর। নদীতে গেলে তার পর। মোহনা আর বেশি দূরে নেই। দেখা যাচ্ছে। কিন্তু নদীটা কোথায়?
তাই তো! কোথায়! উধাও হয়ে গেছে নাকি!
বুঝে ফেলল হঠাৎ। লেকটা সোজাসুজি নদীতে পড়েনি। কারণ লেকের সমতলে নেই নদীটা। তারমানে জলপ্রপাত হয়ে নদীতে ঝরে পড়ছে লেকের পানি। সর্বনাশ!
কিশোর!
চমকে ফিরে তাকাল কিশোর। তীরে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। সে তাকাতেই ছিপ নাড়ল।
দাঁড় ভেঙে যাওয়ার কথা নিশ্চয় জানে না মুসা। কিন্তু বুঝতে পারছে কি ভয়ানক বিপদে পড়েছে তার বন্ধু। কিশোর দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু সে পাচ্ছে, তিরিশ ফুট নিচে রয়েছে নদী। প্রচুর পাথর আছে ওখানটায়। পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরছে পানি। নৌকা নিয়ে ওখানে পড়লে আর বাঁচতে হবে না। পাথরে লেগে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে ডিঙি…
দৌড় দিল মুসা। লেকের পাড় ধরে প্রপাতের দিকে। যেখান থেকে ঝরে পড়ছে পানি, তার কিনারে এসে থমকে দাঁড়াল। আর বড় জোর ষাট গজ মত পেরোতে হবে কিশোরকে, তারপরেই পৌঁছে যাবে সে যেখানে রয়েছে সেখানটায়।
সুতোর রিলের ক্যাচটা রিলিজ করে দিল মুসা। ছিপটা তুলে ধরল মাথার ওপর। একটা সুযোগ পাবে সে। মাত্র একটা। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করার সময়ই মিলবে না আর। শক্ত হয়ে দাঁড়াল সে। ডিঙিটার অপেক্ষায়।
সামনে চলে এল নৌকা। মাথার ওপর ছিপ ঘুরিয়ে বড়শি আর সীসা বাঁধা সুতোর মাথাটা যত জোরে সম্ভব ছুঁড়ে দিল লেকের পানির ওপর দিয়ে।
কিশোরের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল সীসাটা। পড়ল গিয়ে ওপাশের পানিতে। হাত বাড়িয়ে সুতোটা ধরে ফেলল সে।
টেনো না! সাবধান করল মুসা, ছিড়ে যেতে পারে! সীসাটা ধরে রাখ শুধু। সুতো ধরে পানি থেকে সীসাটা টেনে তুলে ধরে রাখল কিশোর।
খুব হুঁশিয়ার হয়ে আস্তে আস্তে সুতো গোটাতে আরম্ভ করল মুসা। এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে, এমন ভাবে, যাতে টান খুব কম পড়ে। অনেক বড় মাছ যেভাবে খেলিয়ে তোলে অনেকটা তেমনি করে। নাইলনের সুতো যথেষ্ট শক্ত, কিন্তু তারপরেও যে-কোন মুহূর্তে ছিড়ে যেতে পারে।
সুতোয় টান লাগছে, আর একটু একটু করে এদিকে ঘুরে যাচ্ছে নৌকার গলুই।
সুতো আরও কয়েক ফুট গুটিয়ে ফেলতে পারল সে।
মাঝখানের চেয়ে তীরের কাছাকাছি স্রোত অনেক কম। সেখানেই নিয়ে আসার চেষ্টা করছে মুসা।
আরও কিছুটা গোটাল। কমে আসছে নৌকা আর তার মাঝের দূরত্ব। স্রোতের টান থেকে প্রায় বেরিয়ে এসেছে নৌকাটা।
সুতো ছিড়ল নৌকাটা তীর থেকে দশ গজ দূরে থাকতে। তবে এখন আর অতটা ভয় নেই।
ভাঙা দাঁড়টা দিয়ে জোরে জোরে বাইতে শুরু করল কিশোর। কিন্তু দাঁড়ের চ্যাপ্টা মাথার বেশির ভাগটাই ভেঙে যাওয়ায় পানিতে তেমন চাপ রাখতে পারছে না ওটা।
সুতোর টানে যেমন ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়েছিল নৌকা, এখনও তেমনিই এগোতে লাগল।
তারপর হঠাৎ করেই ভাঙা ডান্ডার মাথা দিয়ে মাটি নাগাল পেয়ে গেল কিশোর। লগি দিয়ে বাওয়ার মত করে বাইতে শুরু করল সে। আরেকটু এগোল নৌকা। পানি ওখানে ফুটখানেক গভীর। লাফিয়ে নেমে পড়ল সে। গলুই ধরে টেনে নৌকাটাকে টেনে নিয়ে এল কিনারে।
দৌড়ে এল মুসা। ওকে নৌকাটা ডাঙায় তুলতে সাহায্য করল।
থ্যাংকস! এছাড়া বলার মত আর কিছুই তখন খুঁজে পেল না কিশোর।
আজকে সবচেয়ে বড় মাছটা ধরলাম, হেসে বলল মুসা। পিরেটোকে বলব, তোমাকে যেন শিকে গেঁথে কাবাব বানিয়ে দেয়। লাঞ্চে খেতে পারব।
আরেকটু হলেই কবরে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল।
পায়ের শব্দ শোনা গেল। দুজনেই দেখল দৌড়ে আসছে রবিন। কিশোর ওকে রেখে চলে আসার পর পড়ায় আর মন বসাতে পারেনি। কৌতূহল চাপতে না পেরে কিশোর কি করে দেখার জন্যে চলে এসেছিল লেকের ধারে। দেখেছে, অসহায় হয়ে নৌকায় করে ভেসে চলেছে গোয়েন্দাপ্রধান। ওকে বাঁচানোর কোন বুদ্ধিই বের করতে পারেনি সে।