অনেক আমেরিকানের সঙ্গেই আপনার পরিচয় আছে মনে হয়, কাজ করতে করতে বলল কিশোর। অল্প বয়েসী কজনের সঙ্গে জানাশোনা আছে?
নেই, গভীর আগ্রহে কিশোরের কাজ দেখছে পিরেটো। দারুণ হাত তো তোমার! আমেরিকার সবাই পারে নাকি?
সবাই পারে না। কেউ কেউ পারে। তথ্য জোগাড়ের জন্যে আবার প্রশ্ন করল কিশোর, অল্প বয়েসী কোন আমেরিকান এই র্যাঞ্চে ছিল নাকি? বেড়াতে-টেড়াতে এসেছিল?
কবে?
তিন-চার মাসের মধ্যে? শারি যখন এল তখন?
হাত ওল্টাল পিরেটো। কত লোকই তো যায় এপথে। মাঝেসাঝে থামে।
ওদের কারও গলার স্বর কি আমার মত ছিল? মনে আছে?
চেহারার কোন ভাবান্তর হলো না মেকসিকান লোকটার। তবে তার কালো চোখজোড়া হাসছে। উত্তর আমেরিকার সমস্ত মানুষকে একরকম লাগে আমার।
আমি গলার স্বরের কথা জিজ্ঞেস করেছি। যাই হোক, আপনার কাছে একরকম লাগলেও শারির কাছে নিশ্চয় তা লাগে না।
মানুষের চেয়ে বারোর কানের ক্ষমতা অনেক বেশি।
নাহ, সুবিধে হচ্ছে না। কিশোর তথ্য জোগাড় করতে চাইছে এটা বুঝে ফেলেছে পিরেটো। কাজেই মুখ খুলছে না। চাপাচাপি করে লাভ নেই।
যন্ত্রটা মেরামত করে জোড়া লাগিয়ে ফেলল কিশোর। সুইচ অন করল। কল সাইন দিয়ে কোন সাড়া মিলল না। অনেক ভাবে অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে দেখল, জবাব এল না। তবে ওয়াকি-টকিটা যে কাজ করছে তাতে সন্দেহ নেই। সাড়া যেহেতু মিলছে না, তার মানে আর কারও কাছে ওয়াকি-টকি নেই। কিংবা হয়তো অন করা নেই।
হয়ে গেছে, বলল সে।
তোমরা আমেরিকানরা বড় চালাক।
কিছু কিছু ব্যাপারে আমেরিকানরা চালাক বটে, তবে কিছু ব্যাপারে আবার বোকাও, ভাবল কিশোর। যাই হোক, সে শুধু আমেরিকান নয়, বাঙালীও। আগামী দিন সকালে ওই মেকসিকান লোকটার চালাকি ধরতে চাইলে ওর আগেই ঘুম থেকে উঠতে হবে তাকে।
ওয়াকি-টকিটা তুলে নিয়ে কিশোরকে ধন্যবাদ জানাল পিরেটো। তারপর কিশোরের হাতটা ধরে আন্তরিক ভঙ্গিতে ঝাঁকিয়ে দিল। সময় করে একদিন অনেক কথা বলব তোমার সঙ্গে। একদিন, যখন… ফোন বেজে ওঠায় বাধা পড়ল তার কথায়। জবাব দেয়ার জন্যে অফিসে চলে গেল। ফিরে এল মুহূর্ত পরেই। তোমার ফোন।
নিশ্চয় ভিকটর সাইমন, ভাবল কিশোর। এখানে আর কারও তাকে ফোন করার কথা নয়।
কিন্তু মিস্টার সাইমন নন। সাড়া দিল একটা মহিলা কণ্ঠ। আমেরিকান। কিশোর পাশা?
হ্যাঁ, কে বলছেন?
তা না জানলেও চলবে। বললেও চিনবে না। তোমাকে একটা জিনিস দেখানো দরকার। তোমার জন্যে খুব জরুরি।
উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর। কোন কেস হঠাৎ করে নতুন মোড় নিলে এরকম হয় তার। এখানে, র্যাঞ্চে চলে এলেই পারেন।
না! র্যাঞ্চের ব্যাপারে ভীত মনে হলো মহিলাকে। ডজ মরগানের র্যাঞ্চে যাওয়া উচিত হবে না আমার। বিপদে পড়ে যাব।
ডজ বাড়িতে নেই। ল্যারেটোতে গেছেন।
না, তবু যেতে পারব না, ভয় কাটাতে পারছে না মেয়েটা। অন্য কেউ দেখে বলে দিতে পারে ডজকে। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। লেকের অন্য পাড়ে চলে এসো।
কি করে যেতে হবে বলে দিল মহিলা। র্যাঞ্চ ছাড়িয়ে কয়েক শো গজ গেলে লেকের পাড়ে একটা নৌকা দেখতে পাবে কিশোর। দাঁড় বেয়ে অন্য পাড়ে গিয়ে উঠে পড়বে ওপরে। বনের ভেতর দিয়ে গির্জার টাওয়ারের কাছে গেলে ছোট একটা গ্রাম দেখতে পাবে। গ্রামের প্রধান চত্বরে অপেক্ষা করবে মহিলা।
একা আসবে, বলে দিল মহিলা। কেউ যদি তোমার সঙ্গে থাকে, কিংবা আসার সময় কেউ তোমাকে দেখে ফেলেছে বলে মনে হয় আমার, লুকিয়ে পড়ব। আর আমাকে দেখতে পাবে না।
কি দেখাতে চাইছেন? জবাব নেই।
কেটে দিয়েছে লাইন।
৭
বারান্দায় এল কিশোর। একমনে মেকসিকোর ইতিহাস পড়ছে রবিন। সাড়া পেয়ে ফিরে তাকাল।
কি?
মহিলার কথা জানাল কিশোর।
হয়তো সেই আমেরিকানের ছবি দেখাবে, আন্দাজ করল রবিন। শারি যার ভক্ত।
শ্রাগ করল কিশোর। তারও এ কথাই মনে হয়েছে। তবে সেটা শুধুই অনুমান।
আমি আসব? জিজ্ঞেস করল রবিন।
একা যেতে বলেছে, জানাল কিশোর।
হুম! তাহলে তো, আর কিছু করার নেই। যাও। লোকজন জোগাড় করে রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে তোমার জুডো ব্যবহার করতে হবে আর কি। হাসল রবিন।
জবাব দিল না কিশোর। নেমে পড়ল বারান্দা থেকে। লেকের দিকে চলল। লেকের পাড়ে এসে মুসাকে দেখতে পেল না। কোথায় বসল?
নৌকাটা খুঁজে পেল সহজেই। কাঠের ছোট একটা ডিঙি। সীটের নিচে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে একটা দাঁড়। নৌকাটাকে পানিতে ঠেলে দিয়ে লাফিয়ে উঠে বসল তাতে। দাঁড়ের আংটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল দাঁড়টা।
বাইতে শুরু করল সে।
যতটা সহজ হবে ভেবেছিল ততটা হলো না। নাক সোজা রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। কারণটা বুঝতে পারছে। তীরে দাঁড়িয়ে অতটা বোঝা যায় না। পানিতে স্রোতের খুব জোর।
বেশি চাপাচাপি করতে গিয়ে হঠাৎ মট করে ভেঙে গেল দাঁড়টা। একটানে স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেল ভাঙা অংশটাকে। হাতের টুকরোটার দিকে বোকা হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোর। পুরানো মনে হয়েছিল তখনই, কিন্তু পচে যে এতটা নরম হয়ে আছে কল্পনাই করতে পারেনি।
দাঁড় দিয়ে নৌকা সোজা রাখতে কষ্ট হচ্ছিল, এখন তো রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। লেজ চুলকালে সেটাকে কামড়ানোর জন্যে কুকুর যেভাবে এক জায়গায় ঘুরতে থাকে তেমনি করে ঘুরতে লাগল নৌকাটা। নানা ভাবে চেষ্টা করে দেখল কিশোর। কোন কাজ হলো না। স্রোতের টানে ভেসে চলল।