মূর্তির পাশে ঘাসের ওপর পড়ে আছে ভাঙা মাথাটা। মুখের হাঁ-এর ফাঁকে লাল রঙ করা। কাছেই মাটিতে পড়ে আছে একটা ধাতব ভারি জিনিস।
ওটা পড়েই ভেঙেছে, বললো সে। আগুন নেভানোর কেমিক্যালের সিলিণ্ডার। নিশ্চয় প্লেন থেকে পড়েছে, মূর্তিটার ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় ফেলা হয়েছে।
মাথাটা ভালোমতো দেখার জন্যে ওটার কাছে বসে পড়লো মুসা। ঘাড়ের অনেকখানি নিয়ে ভেঙেছে মাথা। ডেটা ফাপা। নিশ্চয় ওজন কমানোর জন্যেই ওরকম করে তৈরি করা হয়েছিলো। কি যেন একটা বেরিয়ে রয়েছে ভেতর থেকে। টেনে বের করলো সে। কি জিনিস?
দেখি তো? ওর হাত থেকে জিনিসটা নিলো কিশোর।
চামড়া আর ধাতুর তৈরি লম্বা, পাতলা একটা সিলিন্ডারের মতো জিনিস, ভেতরে ফাপা। হুঁ, ধীরে ধীরে বললো কিশোর, লাগছে তো তলোয়ারের খাপের মতো। ওই যে, কোমরে ঝুলিয়ে নিতো যেগুলো সৈন্যরা…
কিন্তু বেশি বড়, রবিন বললো। খাপে খাপে মিলবে না, ঢিলে হয়ে থাকবে তলোয়ার।
হা। আর বেল্টে ঝোলানোর জন্যে কোনো হুকটুকও নেই।
দেখি, হাত বাড়ালো রিগো। না, তলোয়ারের খাপ না এটা, ঢাকনা। খাপের খোলস। খুব দামী তলোয়ারকে আগে এভাবেই যত্ন করে রাখা হতো। যাতে খাপটারও ক্ষতি না হয়। বিশেষ করে যখন ব্যবহার হতো না। অনেক পুরানো মনে হচ্ছে।
পুরানো? দামী? উত্তেজিত হয়ে উঠলো পিনটু। কটেজ সোর্ড-এর খোলস না তো! মুসা, দেখো তো, মাথাটার ভেতরে ভালো করে দেখো…
ততোক্ষণে ভাঙা ঘাড়ের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে মুসা। ঘাড় দেখলো, মাথা দেখলো, তারপর পুরো মূর্তিটার ভেতরেই দেখলো। মাথা নেড়ে বললো, ঘাড়-মাথার ভেতরে কিছু নেই। ধড় আর পায়ের ভেতরে ফাঁপা নয়। সলিড।
বোকামি করছিস, পিনটু, রিগো বললো। অনেক আগেই হারিয়ে গেছে কটেজ সোর্ড।
দামী ছিলো? মুসার প্রশ্ন।
হয়তো ছিলো, তবে আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না। হয়তো আর দশটা সাধারণ তলোয়ারের মতোই ছিলো ওটা, ঐতিহাসিক কারণে দামী হয়ে গেছে। অনেক দিন নাকি ছিলো আমাদের পরিবারে।
করটেজের ব্যক্তিগত জিনিস? রবিন জিজ্ঞেস করলো।
পারিবারিক ইতিহাস তো তাই বলে। ডন নিরো আলভারেজ, নিউ ওয়ার্ল্ডে আমাদের প্রথম পূর্ব-পুরুষ, একবার গুপ্ত আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছিলেন করটেজের সেনাবাহিনীকে। খুশি হয়ে তখন তাঁকে নিজের তলোয়ারটা উপহার দিয়েছিলেন কটেজ। তলোয়ারটা সম্পর্কে কিংবদন্তী আছে, স্পেনের রাজা নাকি বিশেষ উপলক্ষে অনেক আয়োজন করে ওটা উপহার দেন কাটেজকে। খাঁটি সোনার তৈরি বাঁট, দামী পাথর বসানো। ফলা আর খাপটাতেও নাকি পাথর বসানো ছিলো। ওটা এই অঞ্চলে নিয়ে আসেন নিরো আলভারেজের বংশধর লেফটেন্যান্ট ডারিগো আলভারেজ।
তারপর কি হলো ওটার? আগ্রহী হয়ে উঠেছে কিশোর।
আঠারোশা ছেচল্লিশ সালে মেকসিকোর যুদ্ধের সময় আমেরিকানরা যখন রকি বীচে ঢুকতে আরম্ভ করে, তখন হারিয়ে যায় ওটা। একেবারে গায়েব।
আমেরিকান সৈন্যরা চুরি করেছিলো?
হয়তো। দামী জিনিস যা-ই পেতে তুলে নিয়ে যাওয়ার স্বভাব ছিলো ওদের। পরে সেনাবাহিনীর দপ্তরে খোঁজ নেয়া হয়েছে। দপ্তরের লোকেরা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তলোয়ারটার কথাই শোনেনি ওরা। হয়তো সত্যিই বলেছে, কে জানে। আমার দাদার-বাবার-বাবা পিউটো আলভারেজ লড়াই করেছিলেন আমেরিকানদের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্যে পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে সাগরে পড়ে যান। তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। রকি বীচ গ্যারিসন কমাণ্ডারের ধারণা, তলোয়ারটা তখন পিউটোর হাতে ছিলো, ওটা নিয়েই সাগরে পড়েছেন। যা-ই হোক, তলোয়ারটা আর পাওয়া যায়নি।
কিন্তু, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর, একটা কথা ঠিক, কেউ ঠিক করে বলতে পারে না তলোয়ারটা আসলে কোথায় গেছে। এবং কেউ একজন নিশ্চয় ওই খাপের খোলসটা ঢুকিয়ে রেখেছিলো ঘোড়ার গলার মধ্যে…।
ভাইয়া! হাসিয়েনড়া! শৈলগ্রির কিনারে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো পিনটু।
কি হয়েছে দেখার জন্যে ছুটে গেল সবাই। আঁতকে উঠলো হাসিয়েনডার দিকে তাকিয়ে।
আরি, ঘরেও আগুন! রাশেদ পাশা চিৎকার করে বললেন।
জলদি! চেঁচিয়ে উঠলো রিগো।
ঢাল বেয়ে দৌড়ে মাঠের ওপর দিয়ে হুটলো সবাই। লাফিয়ে উঠছে আগুনের শিখা। আকাশে এখনও ভাসমান দাবানলের ধোঁয়ার সঙ্গে মিশতে চলেছে নতুন আগুনের কালো ধোঁয়া। হাসিয়েনডার চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে একটা দমকলের গাড়ি, হোসপাইপ হাতে নিয়ে গোলাঘরের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে কয়েকজন দমকলকর্মী। রিলোর দল ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে ক্ষতি যা করার করে ফেললো আগুন, ধড়াস করে ধসে পড়লো পোড়া ছাত। দুটো বাড়িই পুড়েছে ভালোমতো। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
নাহ, হতাশ ভঙ্গিতে বললো দমকল বাহিনীর ক্যাপ্টেন, লাভ হলো না! দাবানলের আগুনই নিশ্চয় ছিটকে এসেছিলো।
তা কি করে হয়? প্রতিবাদ করলো মুসা। বাতাসই তো ছিলো না। কি করে আসবে?
নিচে ছিলো না,ক্যাপ্টেন বললো। তবে মাটির কাছে না থাকলেও অনেক সময় ওপরে জোর বাতাস থাকে। আর আগুন লাগলে তো বটেই। গরম বাতাস দ্রুত ওপরে উঠে যায়, সাথে করে নিয়ে যায় স্ফুলিঙ্গ, ওপরের বাতাস সেই স্ফুলিঙ্গকে বয়ে নিয়ে যেতে পারে অনেক দূর। ওরকম ঘটতে দেখেছি। ঘরগুলোর কাঠ শুকিয়ে খটখটে হয়েছিলো। আগুন লাগতে দেরি হয়নি। পুরানো বাড়ির কড়িবর্গার কাঠ বেয়ে আগুন নিচে নেমেছে, টালির হাতের নিচে চলে আসার পর সেই আগুনকে আর ছুঁতে পারেনি বৃষ্টি। আরও আগে দেখলে হয়তো বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু তখন এতো ধোঁয়া ছিলো, কোনটা যে কোনখান থেকে উড়ছে বোঝা যায়নি…।