ভিড় আর কাদার দিকে তাকালো রিগো, নিজের দলকে সরিয়ে নিয়ে এলো বায়ে। বললো, আরেকটা পথ আছে। এতে ভিড়ও নেই, কাদাও কম থাকবে, সহজেই চলে যেতে পারবো হাসিয়েনডায়।
বাঁধের কিনার দিয়ে হেঁটে উঁচু শৈলশিরার গোড়ায় একটা বড় ঢিবির কাছে চলে এলো ওরা। জংলা জায়গা, ঝোপঝাড় জন্মে রয়েছে। শৈলশিরার পশ্চিম অংশে অ্যারোইওর পথ রোধ করেছে এই টিবিটাই। প্রায় মুছে যাওয়া একটা পায়ে-চলা পথ চোখে পড়লো এখানে নেমে গেছে বাঁধের তিরিশ ফুট নিচে নালার বুকে। ওটাতে নামার আগে মুখ ফেরালো একবার সবাই, পেছনে দেখার জন্যে। বাঁধের দুধারে যতো দূর চোখ যায়, শুধু পোড়া ঝোপঝাড়। কিন্তু পুড়ে ছাই হয়ে মিশে গেছে মাটিতে, কিছু কালো ডাটা এখনও মাথা তুলে রেখেছে এখানে ওখানে।
গাছপালা নেই। পোড়া মাটি এখন পানি আটকাতে পারবে না, হুগো কললো গজর হয়ে। বৃষ্টি যদি বাড়ে, বন্যা হয়ে যাবে।
টিবির নিচের পথ ধরে নিচে নামতে আরম্ভ করলো দলটা। নালার বুকও এখন আর আগের মতো শুকনো নেই, কাদা হয়ে গেছে। অন্য পারে আরেকটা কাঁচা রাস্তা আছে, ওটা গেছে ডয়েল র্যাঞ্চের ভেতর দিয়ে। যানবাহন আর লোকের ভিড় ওটাতেও। কাউন্টি সড়কের দিকে ওই রাস্তা দিয়েই ফিরে চলেছে দমকল বাহিনী। ডয়েলদের র্যাঞ্চ ওয়াগনটাকে ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে যেতে দেখলো তিন গোয়েন্দা। কয়েকজন লোকের সঙ্গে পেহনে বসেছে টেরি। গোয়েন্দাদের দেখলো ঠিকই, কিন্তু সে-ও এতো পরিশ্রান্ত, টিটকারি মারারও বল পেলো না যেন। এমনকি তার গা জ্বালানো হাসিটা পর্যন্ত হাসলো না।
ওটা কি ডয়েলদের এলাকা? রবিন জিজ্ঞেস করলো।
মাথা ঝাঁকালো রিগো। নালাটাই হলো সীমানা, এদিকটা আমাদের, ওদিকটা ওদের।
ডানে, উঁচু শৈলশিরা যেন হঠাৎ করে ডুব মেরেছে বালির তলায়। ওটার ওপাশে এখন কি আছে দেখা যায়। গোয়েন্দারা দেখলো, একসারি শৈলশিরা এগিয়ে গেছে দক্ষিণে। নালার বুক থেকে উঠে এসে মোড় নিলো রিগো। পায়েচলা পথটা এখানে ঘাসে ঢেকে গেছে। চলে গেছে কতগুলো ছোট পাহাড়ের ভেতর দিয়ে, অনেকটা গিরিপথের মতো। এতে সরু, দুজন পাশাপাশি চলতে কষ্ট হয়। ফলে একসারিতে এগোলো দলটা। এখানে কিছু পোড়েনি, আগুন আসতেই পারেনি এ-পর্যন্ত। প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে চললৈ তিন গোয়েন্দা। পাহাড়ের ঢালে জন্মে রয়েছে নানা জাতের ঝোপ। ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে রয়েছে বাদামী পাথর। মাথার ওপরে এখনও ঝুলে রয়েছে যেন ছাড়া ছাড়া ধোঁয়া। বৃষ্টি থেমে গেছে পুরোপুরি। মেঘের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসেও থাকার সময় পানি আর সূর্য, প্রায় ডুবে গেছে।
আগে আগে হাঁটছে এখন মুসা। তার পাশে চলে এলো কিশোর। পায়েচলা পথ ধরে ওরা যখন শেষ শৈলশিরাটার ওপর উঠলো, দলের অন্যেরা তখন প্রায় বিশ গজ পেছনে পড়েছে।
খাইছে! কিশোওর! হঠাৎ করে ওপরে হাত তুলে দেখালো মুসা।
ওদের মাথার ওপরে ভেসে যাওয়া ধোঁয়ার ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসছে একজন মানুষ। কালো একটা ঘোড়ার পিঠে বসা। গোধূলীর আলোয় হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে দুজনে। সামনের দুপা তুলে দিয়ে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে ঘোড়াটা সামনের খুর দিয়ে যেন লাথি মারতে চাইছে ধোঁয়াকে, মাথাটা…
আরে …আরে…, কথা আটকে যাচ্ছে কিশোরের, ও-ওটার মা-থা কই!
চূড়ার ওপর পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক মুণ্ডুহীন ঘোড়া!
খাইছেরে! ভূউত! গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
৪
দেখে মনে হচ্ছে ধোঁয়ার ভেতর থেকে এই বুঝি লাফিয়ে এসে ওদের ঘাড়ে পড়বে ঘোড়াটা।
তার জন্যে অপেক্ষা করলো না আর দুজনে, ঘুরেই দিলো দৌড়। চিৎকার শুনে ওদের দিকে ছুটে আসতে লাগলো রবিন আর পিনটু। পেছনে সরু পথে চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন রাশেদ পাশা, রিগো, হুগো আর স্টেফানো।
মাথা নেই! মাথা নেই! চেঁচালো আবার মুসা। ঘোড়া-ভূতটার মাথা নেই! এসো না! পালাও!
থমকে দাঁড়ালো রবিন। মুসার মাথার ওপর দিয়ে তাকালো ঘোড়াটার দিকে। ধোঁয়া পাতলা হয়ে এসেছে এখন। তাকিয়েই চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার।
কিশোর, ওটা, ওটা…, কথা শেষ করতে পারলো না রবিন।
হো হো করে হেসে উঠলো পিনটু। আরে কি শুরু করলে! ওটা তো মৃর্তি, করটেজের মূর্তি। ধোঁয়া ভাসছে, ফলে ধোঁয়ার ভেতরের মূর্তিটাকে মনে হচ্ছে নড়ছে।
অসম্ভব! কিছুতেই মানতে রাজি নয় মুসা। করটেজের মূর্তির ঘোড়ার মাথা ছিলো!
মাথা? তাজ্জব হয়ে গেল পিনটু। আরে, তাই তো! মাথা গেল কই! নিশ্চয় কেউ ভেঙে ফেলেছে! ভাইয়া, দেখে যাও!
অন্যদেরকে নিয়ে এসে হাজির হলো রিগো। ঘোড়টার দিকে তাকিয়ে বললো, আশ্চর্য। চল তো দেখি!
কাঠের মূর্তিটার কাছে এসে জড়ো হলো সবাই। এখনও হালকা ধোঁয়া উড়ছে ওটার ওপরে। বিশাল একটা গাছের কাণ্ড কুঁদে তৈরি হয়েছে ঘোড় আর মানুষের আস্ত ধড়টা, পুরোটাই একটা অংশ। হাত, পা, তলোয়ার আর জিন আলাদা তৈরি করে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে ওটার সঙ্গে। ঘোড়াটার শরীরের রঙ কালো, তাতে লাল আর হলুদের অলংকরণ করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে ওখানটায় ঝুলে আছে উঁচু জিনের নিচের ঝালর। আরোহীর রঙও কালো। দাড়ি হলুদ, চোখ নীল, আর লাল রঙে আঁকা রয়েছে আরমার-প্লেট। মলিন হয়ে এসেছে সমস্ত রঙ।
আগে নিয়মিত রঙ করা হতো, পিনটু জানালো। কিন্তু অনেক দিন থেকেই আর তেমন যত্ন নেয়া হয় না। কাঠও নিশ্চয় পচে নরম হয়ে গেছে এতেদিনে।