অনেক ঘর ছিলো আলভারেজদের, জানালো রিগো। এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র একটা হাসিয়েনডা। ওসব ঘরের প্রায় সমস্ত জিনিসপত্ৰই এনে রাখা হয়েছে এখানে।
সব কিনবো আমি! ঘোষণা করে দিলেন রাশেদ পাশা। এই দেখো দেখো! প্রায় চিৎকার করে বললো রবিন। পুরানো আরমার! একটা হেলমেট, একটা ব্রেস্ট-প্লেট …
…একটা তলোয়ার, একটা জিন! রবিনের কথাটা শেষ করলো মুসা। দেখো, জিনের গায়ে আবার রূপার কাজ!!
মালপত্রের মাঝে মাঝে সরু গলিমতো করে রাখা হয়েছে ভেতরে ঢোকার জন্যে। ঢুকে পড়লো তিন গোয়েন্দা। তালিকা তৈরি করার জন্যে সবে নোটবুক ব্বে করেছেন রাশেদ পাশা, এই সময় বাইরে শোনা গেল চিৎকার।
ভালো করে শোনার জন্যে কান পাতলে সবাই। আবার শোনা গেল চিৎকার। স্পষ্ট বোেঝা গেল এবার কি কলহেঃ আন্ন! আগুন!
আগুন লেগেছে! জিনিস দেখা বাদ দিয়ে দৌড় দিলো সবাই দরজার দিকে।
৩
গোলাঘর থেকে ছুটে বেরোলো তিন গোয়েন্দা। হালকা ধোঁয়ার গন্ধ নাকে ঢুকলো। চত্বরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে আর চিৎকার করছে দুজন লোক। রিগো! পিনটু! আগুন! ওই যে! বাঁধের কাছে।
ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রিগোর মুখ। কোরালে দাঁড়িয়েই দেখতে পেলো সবাই, উত্তরের শুকনো বাদামী পর্বতের ভেতর থেকে মেঘলা আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে ধোঁয়া। বিপদটা বুঝতে দেরি হলো না কারোই। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার ওসব পর্বতের ঢালে, খাড়িতে, গিরিপথের যেখানে সেখানে ঘন হয়ে জন্মায় মেসকিট আর চ্যাপাৱালের ঝোপ। প্রায় শুকিয়ে ঝনঝনে হয়ে আছে নিশ্চয় এখন। একটা ঝোপে আগুন লাগার মানেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা, এবং তার অর্থ দাবানল!
জলদি দমকল আর বনবিভাগকে খবর দাও! চেঁচিয়ে উঠলো দুজনের একজন। বেলচা! কুড়াল! জলদি!
দৌড়ে গিয়ে পারবো না! বললো আরেকজন। ঘোড়া লাগবে, ঘোড়া!
তারচে আমাদের ট্রাকে করে চলুনা পরামর্শ দিলো কিশোর। ঠিক! সায় জানালো রিগো। এই, বেলচা আর কুড়াল রয়েছে গোলাঘরে!
ট্রাক স্টার্ট দেয়ার জন্যে দৌড় দিলো বোরিস। অন্যেরা গোলাঘরের দিকে ছুটলো আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি আনতে। আগের মতোই বোরিসের পাশে উঠে বসলেন রাশেদ পাশা আর পিনটু। অন্যেরা টপাটপ লাফিয়ে উঠে পড়লো ট্রাকের পেছনে। ট্রাকের দুধার খামচে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো, যাতে উঁচু-নিচু জায়গায় চলার সময় আঁকুনিতে ছিটকে না পড়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে দুজন লোকের পরিচয় করিয়ে দিলো রিগো, যারা চিৎকার করে আগুনের কথা জানিয়েছে।
আমাদের বন্ধু, পুয়ের্তে হুগো, আর ডা স্টেফানো, এক এক করে দুজনকে দেখালো রিগো। কয়েক পুরুষ ধরে হাসিয়েনডা আলভারেজে কাজ করছে। এই পথের ধারেই এখন বাড়ি করেছে দুজনে। শহরে কাজ করে। তবে অবসর সময়ে এখনও আমাদের র্যাঞ্চের কাজ করে দেয়।
দুজনেই বেঁটে। কালো চুল। খুব ভদ্রভাবে মাথা নুইয়ে সৌজন্য দেখালো তিন গোয়েন্দাকে। তবে চোখের উৎকণ্ঠা তাতে ঢাকা পড়লো না। ট্রাকের কেবিনের ওপর দিয়ে আবার ফিরে তাকালো ওরা আগুনের দিকে। রোদ-বাতাসে অল্প বয়েসেই ভাঁজ পড়েছে মুখের চামড়ায়, উদ্বেগে গভীর হলো সেগুলো। অস্বস্তিতে হাত ডললো পুরানো জিনসের প্যান্টের পেছনে।
সোজা উত্তরে ছুটেছে ট্রাক। ঘন হচ্ছে এখন ধোঁয়া। ঢেকে দিচ্ছে মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা মলিন রোদকে। আগুনের দিকেই নজর, তবু, পথের পাশের সজী বাগানগুলো চোখ এড়ালো না ওদের। দক্ষিণের একটা মাঠের দিকে ছুট দিয়েছে একপাল ঘোড়া। শুরুতে অ্যারোইও আর শৈলশিরার পাশাপাশি চললো কাঁচা রাস্তাটা, তারপর পর্বতের কাছাকাছি এসে দুভাগ হয়ে গেল। আগুনটা ডান দিকে, তাই ডানের পথই ধরলো বোরিস। রুক্ষ এবড়োখেবড়ো পথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে ছুটে চলেছে ট্রাক, ছড়িয়ে পড়া ধোঁয়া লক্ষ্য করে। বাঁক নিয়ে সোজা অ্যারোইওর দিকে এগিয়েছে পথ। হঠাৎ করেই যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়েছে একটা পাথুরে শৈলশিরার গোড়ায়। খানিক দূরে শিরাটাও যেন আচমকাই শেষ হয়ে গেছে। এবং তার পরে ডানে একটা পুরানো পাথরের বধ, তার ওপ্র দিয়ে হুটলো টাক। বাধে নিচে সান্তা ইনেজ ক্রীকে শুকনো বুক দীর্ঘ বাঁক নিয়ে এগিয়ে গেছে দক্ষিণ-পুবে শৈলশিরার একেবারে দূরতম প্রান্তের কাছে। বাঁধের পেছনে রিজারভোয়ার অর্থাৎ রিগোর দীঘি, বড়জোর একটা পুকুর বলা চলে ওটাকে, পর্বতের পায়ের কাছে শুয়ে শুয়ে যেন ঝিমোচ্ছে ক্লান্তিতে। পুকুরের পাশ দিয়ে ঘুরে ছুটলো ট্রাক। সামনে লাফিয়ে ওঠা আগুনের শিখা চোখে পড়লো এতোক্ষণে।
থামো। থামো! কেবিরে জানালার পেছনে মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো রিগো।
ঘ্যাচ করে ব্রেক কষলো বোরিস। এগিয়ে আসা আগুনের কাছ থেকে শখানেক গজ দূরে। লাফিয়ে নেমে পড়লো সবাই।
ছড়াও! ছড়িয়ে পড়ে! নির্দেশ দিলো রিগো। ঝোপের মাঝখানে কেটে দাও, আলাদা হয়ে যাক। বালি খুঁড়বে আগুনের ওপর। কোনোমতে ঠেলে পুকুরের দিকে নিয়ে যেতে পারলে বাঁচোয়া! জলদি ফ করো!
নালার দুই পাশেই আগুন জ্বলছে, অনেকটা অর্ধচন্দ্রাকারে। নিচে লাল আগুন, ওপরে কালো ধোঁয়ার একটা বিচিত্র দেয়াল যেন কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসছে, ছড়িয়ে পড়ছে দুপাশে। হড়াচ্ছে লাফ দিয়ে দিয়ে। এইমাত্র যেখানে দেখা যাচ্ছে সবুজ ঝোপ, পরমুহূর্তেই সেখানে লাল আগুন, দেখতে দেখতে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলছে।