এতো সহজে নিতে দেবো না, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলো যেন রিগো। খুব একটা ভালো জায়গা নয় ওটা, ভালো তৃণভূমি নেই, ফসল ফলানো কঠিন। শুধু বাপ-দাদার জায়গা বলেই ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছি। পড়ে থাকবো। ঘাস বেশি নেই বলে গরু তেমন পোষা যাচ্ছে না। তবে বিকল্প হিসেবে ঘোড়ার প্রজনন শুরু করেছি আমরা। অ্যাভোক্যাডো গাছ লাগিয়েছি। ছোটখাটো একটা তরকারীর খামারও করেছি। তারপরেও আমার বাবা আর চাচাকে গিয়ে শহরে নানারকম কাজ করতে হয়েছে র্যাঞ্চটা খাড়া রাখার জন্যে। এখন তারা নেই, মারা গেছে। র্যাঞ্চটা টিকিয়ে রাখতে হলে এখন আমাকে আর পিনটুকেও গিয়ে তাদের মতো কাজ করতে হবে।
কাউন্টি রোড ধরে চলেছে এখন ট্রাক। পাহাড়ী অঞ্চল। উত্তরে চলেছে ওরা। ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে পথ। হঠাৎ করেই যেন পাহাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ছড়ানো একটা সমতল জায়গায়। বাঁয়ে সামান্য মোড় নিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে গেছে এখন রাস্তাটা। মোড়ের কাছ থেকে আরেকটা কাছা রাস্তা বেরিয়ে গেছে ডানে।
সেই রাস্তাটা দেখিয়ে রিগো কললো, ডয়েল র্যাঞ্চে গেছে ওটা।
দূরে ডয়েল র্যাঞ্চ দেখতে পেলো গোয়েন্দারা, তবে বাড়িটার পাশে কোনো গাড়িটাড়ি চোখে পড়লো না। টেরি আর ডরি কি তাহলে ফেরেনি?
কাউন্টি রোডটা যেখানে মোড় নেয়া শেষ করেছে ওখানে একটা ছোট পাথরের ব্রিজ আছে। নিচে শুকনো খট খটে বুক চিতিয়ে রেখেছে যেন পাহাড়ী নালা, পানি নেই।
সান্তা ইনেজ ক্রীক, নালাটা দেখিয়ে বললো রিগো, আমাদের সীমানা এখান থেকে শুরু। বৃষ্টি না নামলে আর পানি আসবে না ওটাতে। ওটা ধরে মাইলখানেক উত্তরে বাঁধ। ওই ওদিকে।
কতগুলো শৈলশিরা দেখালো সে। বোঝালো বাধটা ওগুলোর ওপাশে। নালার অন্যপাশে রয়েছে একটা শিরা, কাউন্টি রোডের সঙ্গে তাল রেখে পাশাপাশি এগিয়ে গেছে। উত্তরের পর্বতের গায়ে গ্রিগুলো এমনভাবে বেরিয়ে রয়েছে, দেখে মনে হয় হাতের হুড়ানো আঙুল।
আঙুলগুলোর পাশ দিয়ে গেছে পথ। শেষ আঙুলের কাছে এসে হাত তুলে দেখালো রিগো। ওটার ওপরে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা কালো বিশাল মূর্তি-ঘোড়ার পিঠে বসে আছে ঘোড়সওয়ার, একটা হাত এমন ভাবে তুলে রেখেছে, মনে হয় যেন পেছনের সেনাদলকে এগোনোর নির্দেশ দিচ্ছে।
মহাবীর কটেজ, গর্বের সঙ্গে বললো রিগো। আলভারেজদের প্রতীকই বলা চলে ওটাকে। আলভারেজ হীরো। দুশো বছর আগে বানিয়েছিলো ইনডিয়ানরা।
শেষ শিরাটা পেরোনোর পর আবার দেখা গেল সমভূমি। আরেকটা পাথরের বিজ পেরোতে হলো। নিচে গভীর খাদ, এটাও শুকনো।
আরেকটা নালা? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
নালা হলে তো ভালোই হতো, রিগো বললো। এটার মেকসিকান নাম অ্যারোইও। জোর বৃষ্টি হলেই শুধু এসব অ্যারোইওতে পানি জমে। আর কোনো উৎস নেই।
আর উৎস মানে?
পর্বতের গা থেকে বেরোনো ঝর্নার কথা বলছি। সান্তা ইনেজ ক্রীকে যেমন আসে।
সান্তা ইনেজ ক্রীকেও না বললেন বৃষ্টি হলে পানি আসে?
হ্যাঁ, তাই তো। বৃষ্টি হলে পর্বতের ভেতরের ফাঁকফোকরে পানি ঢুকে যায়, ঝর্না হয়ে বেরিয়ে আসে আবার নিচের নালা বেয়ে। কিন্তু অ্যারোইওর মুখ বন্ধ থাকে বলে ঢুকতে পারে না।
ডানে মোড় নিয়ে একটা কাঁচা রাস্তায় নামলো ট্রাক। পথের দুপাশে এখানে অ্যাভোকাডো গাছ লাগানো। আরেকবার ডানে মোড় নিয়ে পথটা বেরিয়ে এলো একটা ছড়ানো, খোলা চত্বরের মতো জায়গায়।
সিয়েনডা অ্যালভারেজে স্বাগতম, নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো রিগো। নিচের মাটিতে ধুলো জমে আছে। লাফ দিয়ে দিয়ে ট্রাক থেকে নামলো গোয়েন্দারা। লম্বা, নিচু হাতওলা একটা বাড়ি। দেয়ালে সাদা চুনকাম। কোটরে বসা চোখের মতো যেন ক্ষ দেয়ালের গভীরে বসে রয়েছে জানালাগুলো। লাল টালির ঢালু ছাত। কালচে বাদামী রঙের খুঁটি আর কড়িকাঠের ওপর ভর দিয়ে হাতটা এসে যেন ঝুলে রয়েছে বারান্দার ওপর। এই বাড়িটাই অ্যালভারেজদের হাসিয়েনডা। বাঁয়ে ঘোড়ার ঘর, এটারও হাত নিচু। অনেকটা গোলাঘরের মতো দেখতে। সামনে তারের বেড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কোরাল। মুরগীর খোয়াড়ের বাইরে যেমন দিনের বেলা চরে খাওয়ার জন্যে ঘেরা জায়গা থাকে, কোরালও অনেকটা এরকমই। কোরাল আর গোলাঘরের চারপাশে গজিয়ে উঠেছে বাকাচোরা ওকগাছ। নভেম্বরের এই মেঘলা বিকেলে সব কিছুই কেমন যেন মলিন, বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।
হাসিয়েনডার পেছনে খানিক দূরেই দেখা গেল সেই অ্যারোইওটা, যেটা পেরিয়ে এসেছে ট্রাক। তার ওপাশে মাথা তুলে রেখেছে শৈলশিরাগুলো। হাত তুলে করটেজের মূর্তিটা চাচাকে দেখালো কিশোর।
ওটাও কি বিক্রি হবে? রিগোকে জিজ্ঞেস করে বসলেন রাশেদ পাশা কিছু না ভেবেই।
না না, রিগো মাথা নাড়লো। বিক্রির জিনিস রয়েছে গোলাঘরের ভেতরে।
কোরারে কাছে ট্রাক পিছিয়ে নিতে শুরু করলো বোরিস। অন্যেরা দ্রুত এগোলো ধুলো মাড়িয়ে গোলাঘরের দিকে। ভেতরে আলো খুব কম। একটা কাঠের হুকের মাথায় হ্যাটটা প্রায় ছুঁড়ে ফেললো রিগো, পারিবারিক রত্নগুলো ভালোমতো দেখার এবং দেখানোর জন্যে। হাঁ হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা।
লম্বা ঘরটার অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে ঘোড়া রাখার স্টল, আর কৃষিকাজের সাধারণ যন্ত্রপাতি। বাকি অর্ধেকটা গুদাম। মেঝে থেকে হাত পর্যন্ত জিনিসপত্রে বোঝাই। টেবিল, চেয়ার, ট্রাংক, আলমারি, লণ্ঠন, কাজের যন্ত্রপাতি, জমকালো পোশাক, তৈজসপত্র, গোসল করার ব্রিট গামলা আর আরও নানা জিনিস। দুই চাকার একটা রানো ঠেলাগাড়িও দেখা গেল। দেখে তিন গোয়েন্দার মতোই স্তব্ধ হয়ে গেছেন রাশেদ পাশাও।