কয়েক মিনিট পরেই স্যালভিজ ইয়ার্ডের একটা ট্রাক উত্তরে রওনা হলো। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, পার্বত্য এলাকার দিকে চলেছে, আলভারেজদের র্যাঞ্চের দিকে। গাড়ি চালাচ্ছে ইয়ার্ডের কর্মচারী, ব্যাভারিয়ান ভাইদের একজন, বোরিস। পাশে বসেছেন রাশেদ পাশা আর পিনটু। ট্রাকের পেছনে চড়ে চলেছে কিশোর, মুসা, রবিন আর রিগো। নভেম্বরের বিকেলের রোদ এখনও মুছে যায়নি, তবে পর্বতের মাথায় কালো মেঘ জমতে আরম্ভ করেছে।
সেদিকে তাকিয়ে রবিন বললো, বৃষ্টি তাহলে নামবে মনে হয়। গত মে-এর পর থেকে এক ফোঁটা বৃষ্টিও হয়নি। সময় হয়েছে এখন। যখন তখন শুরু হতে পারে শীতের বর্ষণ।
কাঁধ ঝাঁকালো রিগো। মনে হয়। না-ও হতে পারে। গত কিছু দিন ধরেই দেখছি, মেঘ জমে, কেটে যায়, জমে আবার কেটে যায়। বৃষ্টি হলে ভালোই হতো। পানি দরকার। আমাদের দীঘিটা আছে বলে বেঁচে গেছি। ওটার পানিতেই চলে সারা বছর। তবে এবছর খরা পড়েছে বেশি, পানি একেবারে নিচে নেমে গেছে। শীঘ্রি বৃষ্টি হলে বিপদ হবে।
পথের পাশে শুকনো বাদামী অঞ্চল। মাঝে মাঝে ওক গাহ, সবুজ পাতাগুলো লালচে হয়ে আছে ধূলিতে।
সেদিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো রিগো, একসময় এসবই ছিলো আলভারেজদের জায়গা। এদিকের উপকূল থেকে শুরু করে ওদিকে ওই যে ওই পর্বতের একেবারে গোড়া পর্যন্ত। বিশ হাজার একরের বেশি।
দ্য আলভারেজ হাসিয়েনডা, মাথা ঝাঁকিয়ে বললো রবিন। পড়েছি। স্পেনের রাজার কাছ থেকে এই জমি ভোগদখলের অনুমতি পেয়েছিলো আলভারেজরা।
হ্যাঁ, রিগো বললো। অনেক দিন ধরে এখানে আছি আমরা। প্রথম যে ইউরোপিয়ান মানুষটি ক্যালিফোর্নিয়ায় পা রাখেন তাঁর নাম হুয়ান ক্যাবরিলো। পনেরো শো বিয়াল্লিশ সালে এটা স্পেনের সম্পত্তি বলে দাবি করেন। কিন্তু তারও আগে থেকেই আমেরিকায় ছিলেন নিরো আলভারেজ। হারনানদো করটেজের সেনাবাহিনীতে একজন সৈনিক ছিলেন তিনি। করটেজের নাম নিশ্চয় অনেহো, পনেরোশো একুশ সালে দক্ষিণ মেকসিকোতে আজটেকদেরকে পরাজিত করেছিলেন যে বীর সেনাপতি।
খাইছে! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। তারমানে প্লাইমাউথ রকে খ্রীষ্টান তীর্থযাত্রীদের ঢোকারও একশো বছর আগের ঘটনা সেটা।
তাহলে আলভারেজরা ক্যালিফোর্নিয়ায় এলো কবে? এই ইতিহাস শুনতে খুব ভালো লাগছে কিশোরের, আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো।
অনেক পরে, রিগো জানালো। ক্যাবরিলো ক্যালিফোর্নিয়ায় ঢোকার পর থেকেই ধীরে ধীরে স্প্যানিশ এই এলাকায় ঢুকতে আরম্ভ করলো। তবে ঠিকমতো বসতি জমাতে দুশো বছরেরও বেশি সময় লেগে গেল তাদের। এর কারণ, নিউ স্পেনের তৎকালীন রাজধানী মেকসিকো সিটি থেকে ক্যালিফোর্নিয়া অনেক দূরে। দুর্গম ছিলো তখন এই এলাকা, আর ভয়ংকর ছিলো এখানকার ইনডিয়ানরা। শুরুর দিকে তো স্থলপথে এখানে আসতেই পারতো না স্প্যানি, আসতো সমুদ্রপথে।
ক্যালিফোর্নিয়াকে তখন দ্বীপ মনে করতো স্প্যানিশরা, তাই না? কিশোর কলো।
মাথা ঝাঁকালো রিগো।। তারপর, সতেরোশো ঊনসত্তর সালে স্থলপথে এক অভিযান চালালেন ক্যাপ্টেন গ্যাসপার ডা পরটোলা। উত্তরে এগোতে এগোতে তিনি পৌঁছে গেলেন স্যান দিয়েগোতে। আমাদের পূর্বপুরুষ লেফটেন্যান্ট ডারিগো আলভারেজ ছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে। সান ফ্রানসিসকো বে-এর অনেক জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখলেন পরটোলা। তারপর সতেরোশো সওর সালে মনটেরোতে বসতি স্থাপন করলেন। ওই সময়ই রকি বীচকে চোখে লেগে গিয়েছিলো ডারিগোর। ঠিক করলেন, এখানেই বসতি করবেন। ক্যালিফোর্নিয়ার প্রভিনশিয়াল গভার্নমেন্টের কাছে দরখাস্ত করলেন জায়গা চেয়ে। অনুমতি পেলেন সতেরোশো চুরাশি সালে।
আমার তো ধারণা ছিলো স্পেনের রাজা তাকে জমি দিয়েছেন, মুসা কললো।
মাথা ঝাঁকালো রিগো। একদিক থেকে তা-ই করা হয়েছে আসলে। নিউ স্পেনের সমস্ত জায়গাই অফিশিয়ালি তখন রাজার সম্পত্তি। তাঁর পক্ষেই অনুমতিপত্র সই করতেন তৎকালীন মেকসিকো আর ক্যালিফোর্নিয়ার গভার্নার। ডারিগো পেলেন ফাইভ স্কোয়ার লীগস, অর্থাৎ বিশ হাজার একরেরও বেশি। এতো জায়গা ছিলো, অথচ এখন আমাদের আছে মাত্র একশো একর।
বাকি জমি? জানতে চাইলো রবিন।
বাকি? বিষণ্ণ চোখে ট্রাকের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া জমির দিকে তাকিয়ে রইলো রিগো এক মুহূর্ত। বোধহয় ঈশ্বরের বিচার! ইনডিয়ানদের কাছ থেকে তাদের জায়গা কেড়ে নিয়েছিলো স্প্যানিশরা; কাজেই ও-জমি তাদের দখলে থাকবে কেন? যাবেই। বছরের পর বছর আলভারেজদের সংখ্যা বেড়েছে, জমি ভাগাভগি হয়েছে। কিছু বিক্রি করেছে, কিছু কায়দা করে দখল করে নিয়েছে শরা, আর কিছু কেড়ে নিয়ে গেছে কলোনির উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা।
ধীরে ধীরে হোট থেকে ছোট হয়ে এলো আমাদের র্যাঞ্চ। কিন্তু জমিদারি মেজাজ আর অহংকার হাড়তে পারিনি আমরা। বড় বড় লোকদের সঙ্গে ছিলো আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মীয়তা। ক্যালিফোর্নিয়ার শেষ মেকসিকান গভার্নার পিও পিকো ছিলেন আমাদের আত্মীয়। বহু বহুর আগে করটেজের একটা মৃর্তি স্থাপিত হয়েছিলো আলভারেজদের জমিতে, এখনও সেটা আমাদের সীমানার মধ্যেই আছে।
মিষ্টার ডয়েল তাহলে আপনাদের এই শেষ সম্বলটুকু ছিনিয়ে নিতে চাইছেন, সহানুভূতি মিশিয়ে বললো মুসা।