নাআআ!
তীক্ষ্ণ, কঠিন আরেকটা কণ্ঠ যেন চাবুকের মতো আছড়ে পড়ে জমিয়ে দিলো সবাইকে। কোনদিক থেকে এসেছে সে, উত্তেজনার মাঝে খেয়াল করেনি কেউ। পিনটুর একটা বড় সংস্করণ মনে হচ্ছে লোকটাকে। চেহারার মিল তো রয়েছেই, পোশাক-আশাকও অবিকল একরকম, শুধু পিনটুর চেয়ে লম্বা আর বয়েস কিন্তু বেশি এই যা। আর মাথায় একটা কালো সমব্রেরো হ্যাট রয়েছে। পাথর কুঁদে তৈরি যেন মুখ, কালো শীতল চোখ। কেউ এগোবে না, গর্জে উঠলো আবার লোকটা। ওরা লেগেছে, ওদেরকেই মীমাংসা করতে দাও।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার ফিরে এলো কাউবয়, হেলান দিয়ে দাঁড়ালো গাড়ির গায়ে। মুসাও দাঁড়িয়ে গেছে। চেয়ে রয়েছে রবিন আব কিশোর। জ্বলন্ত চোখে সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে আবার পিনটুর দিকে তাকালে টেরি। রাস্তায় নেমে গেছে দুজনে। টেরির শার্ট ছেড়ে দিয়েছে পিনটু। ঘুসি তুলে এগিয়ে গেল তাকে মারার জন্যে।
বেশ, সেঁড়ো, দেখাচ্ছি মজা! বলে ঘেঁকিয়ে উঠলো টেরি।
র্যাঞ্চ ওয়াগনের একটু দূরে আরেকটা গাড়ি পার্ক করা। মাঝখানের খালি জায়গায় বাধলো লড়াই। হঠাৎ লাফিয়ে পিছিয়ে গেল টেরি, ভালোমতো সই করে একটা ঘুসি ঝাড়ার জন্যে।
সরো! সরো। একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো রবিন আর মুসা।
পিছিয়ে একেবারে রাস্তার মাঝে চলে গেছে টেরি। খেয়ালই করেনি গাড়ি আসছে। চোখ পিনটুর দিকে। টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা গেল। ব্রেক কষেছে ড্রাইভার, কিন্তু বাঁচাতে পারতো না টেরিকে, যদি সময়মতো ডাইভ দিয়ে না পড়তে পিনটু। করে এক প্রচণ্ড ধাক্কায় টেরিকে সরিয়ে দিলো গাড়ির সামনে থেকে। তাকে নিয়ে গিয়ে পড়লো মাটিতে।
ক্ষণিকের জন্যে নিশ্চল হয়ে পড়ে রইলো দুটো দেহ। চেঁচামেচি করে ছুটে গেল দর্শকরা।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো পিনটু, হাসিমুখে। টেরিও উঠলো। ক্ষতি হয়নি তারও।
পিনটুর পিঠ চাপড়ে বাহবা দিলো মুসা। গাড়ি থেকে নেমে তাড়াহুড়ো করে ছুটে এলো ড্রাইভার। পিনটুকে বললো, দারুণ হেলে তো হে তুমি? তা কোথাও লাগেনি তো?
মাথা নাড়লো পিনটু। ওকে ধন্যবাদ দিয়ে টেরির দিকে এগোলো ড্রাইভার। তার খোঁজখ নিলো। যখন দেখলো কারোরই কোনো ক্ষতি হয়নি, আবার গিয়ে উঠলো গাড়িতে। চলে গেল। টেরি তখনও পা ছড়িয়ে বসে আছে। কাঁপছে মৃদু মৃদু। চেহারা ফ্যাকাসে।
এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে টান দিলো তার কাউবয় সঙ্গী। ওঠো! অল্পের জন্যে বেঁচেছে। ওঠো!
ও…ও আমাকে বাঁচালো। বিড়বিড় করলো টেরি।
কি মনে হয় তোমার? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা। ধন্যবাদ দাও ওকে।
থ্যা-থ্যাংকিউ, পিনটু,কাপা গলায় বললো টেরি। শু
ধু থ্যাংকিউ? কড়া গলায় বললো পিনটু। আর কিছু না?
দ্বিধায় পড়ে গেল টেরি। আর আবার কি?
আর? কেন ভুলে গেছো মাপ চাওয়ার কথা? জলদি মাপ চাও। নইলে এসো, দেখি, আবার হয়ে যাক এক হাত।
ছেলেটার দিকে দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরবে চেয়ে রইলো টেরি।
কি হলো? ভুরু নাচালো পিনটু। কথা বলছো না কেন? কথা ফিরিয়ে নাও। আর মাপ চাও।
লাল হয়ে গেল টেরির গাল। বেশ, তাতে যদি খুশি হও-ফিরিয়ে নিলাম আমার কথা…
হাত তুললো পিনটু। ঠিক আছে, আর মাপ চাইতে হবে না। এমনিতেই মাপ করে দিলাম। বলে ঘুরে দাঁড়ালো সে।
এই, শোনো…,বলতে ঝলতেই টেরির চোখ পড়লো তিন গোয়েন্দার হাসিমুখের দিকে, তার দিকে তাকিয়েই হাসছে। রাগে লাল হয়ে গেল মুখ। ঝটকা দিয়ে ঘুরে গটমট করে এগোলো র্যাঞ্চ ওয়াগনের দিকে। ডরি! হেঁকে বললো কাউবয়কে, আদেশের সুর, চলো!
পিনটুর দিকে তাকালো এবার ডরি। তারপর তার পাশে দাঁড়ানো কঠিন চেহারার লোকটার দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, কাজটা ঠিক করোনি তোমরা। এজন্যে পস্তাতে হবে।
র্যাঞ্চ ওয়াগলে টেরির পাশে উঠে বসলো ডরি। গাড়ি স্টার্ট দিলো।
২
ডরির হুমকি তখনও যেন কানে বাজছে তিন গোয়েন্দার। দেখলো, চলন্ত ওয়াগনটার দিকে তাকিয়ে আছে পিনটু, চোখে বিতৃষ্ণা।
এই অহংকারই সর্বনাশ করলো আমাদের! দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তার অন্তর থেকে বেরিয়ে এলো ক্ষোভটা।
না, পিনটু, প্রতিবাদ করলো লম্বা লোকটা, এটা অহংকার নয়। আত্মসম্মানজ্ঞান। আলভারেজদের গর্ব।
তিন গোয়েন্দার সঙ্গে লোকটার পরিচয় করিয়ে দিলো পিনটু, আমার ভাই, রিগো। বর্তমানে আমাদের পরিবারের কর্তা। ভাইয়া, এরা হলো আমার বন্ধু, কিশোর পাশা, মুসা আমান, আর রবিন মিলফোর্ড।
ছেলেদের দিকে তাকিয়ে সামান্য একটু মাথা নোয়ালো রিগো। বয়েস পঁচিশের বেশি নয়, পরনের কাপড়-চোপড়ও পুরানো কিন্তু তবু আচার-আচরণই স্পষ্ট বলে দেয় এককালে বড় জমিদার ছিলো বাপ-দাদারা। বললো, তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
ডা নাদা! বলে স্প্যানিশ কায়দায় বাউ করলো কিশোর।
বাহ্! এই প্রথম হাসি ফুটলো রিগোর মূখে। তুমি স্প্যানিশ জানো?
একআধটু চৰ্চা করি ইস্কুলে, কিছুটা লজ্জিত কণ্ঠেই বললো কিশোর। তবে তেমন পারি না। আপনাদের মতো করে বলার তো প্রশ্নই ওঠে না।
স্প্যানিশ কলার দরকার নেই আমাদের সঙ্গে, ভদ্রতা করে কললো রিগো। আমরা নিজেরা যখন কথা বলি দেশী ভাষায়ই বলি। কিন্তু এখন আমরা আমেরিকারও নাগরিক, তোমাদেরই মতো, কাজেই ইংরেজিও আমাদের ভাষা কলা চলে।
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিশোর, তার আগেই অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো মুসা, বলে উঠলো, আচ্ছা, পস্তাবে বলে শাসিয়ে গেল কেন কাউবয়টা?