তা ঠিক। আমি একথা বলতে চাইছি না। আমার কথা, কোর্টে দেখা গেছে। কিটুকে। অনেকেই দেখেছে। তারপর হঠাৎ করে একেবারে লাপাত্তা, কারো। চোখেই পড়লো না, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। পেছনের একটা দরজা দেখিয়ে বললো কিশোর, সামনে দিয়ে ঢুকে ওখান দিয়ে বেরিয়ে যায়নি তো?
বলতে বলতে গিয়ে ঠেলা দিলো পাল্লায়। তার হাতের ছোঁয়া লাগতেই খুলে। গেল ওটা। দেখা গেল সিঁড়ি নেমে গেছে বাড়ির পেছন দিকে। পাশের বাড়ির সামনে। গাড়ি পার্কিডের জায়গা। একটা রাস্তা চলে গেছে ওশন ফ্রন্টের সমান্তরালে, ওটারই নাম স্পীডওয়ে। খোয়া বিছানো, সরু, এবড়ো-খেবড়ো পথ। পার্কিং লটে ঢোকার জন্যে গুতোগুতি করছে ড্রাইভাররা।
পাল্লাটা ভেজিয়ে দিলো কিশোর। দরজার ছিটকানি লাগান না?
ঘর বন্ধ করে বেরোনোর আগে লাগিয়ে যাই। দিনের বেলা খোলাই রাখি। গ্যারেজে যেতে হয়, ডাস্টবিনে ময়লা ফেলতে যেতে হয়। কতোবার খুলবো ছিটকানি?
মাথা ঝাঁকিয়ে সামনের দরজার কাছে ফিরে এলো কিশোর। ছোট একটা ঘণ্টা। আছে। ইলেকট্রিক বীমের সাহায্যে সুইচ অন হয়। কিশোরের শরীরে ওই বীম বাধা। পেতেই বেজে উঠলো ঘণ্টাটা। কোমর সমান, বিড়বিড় করলো সে। বেল না। বাজিয়ে সহজেই বীমের নিচে দিয়ে চলে যেতে পারে কিটু। আপনি ক্ষণিকের জন্যে এখান থেকে সরলেও চলে যেতে পারে, পলকে।
শূন্য দৃষ্টিতে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইলো ক্যাম্পার। তারপর হাসলো। ও, গত হপ্তায় এভাবেই ঢুকেছিল তাহলে! তাই তো বলি, জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ফেলে রেখে গেল, ঘণ্টা বাজলো না কেন?
বীম এড়িয়ে যে ওটুকু একটা বাচ্চা ছেলে ঢুকতে পারে, খেয়ালই করেননি। কখনও? বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর।
নাহ্!
ওরা যখন কথা বলছে, মুসা তখন ঘুরে ঘুরে দেখছে গ্যালারিটা। বড় ডিসপ্লে উইণ্ডোর সামনে রাখা বেদিটার কাছে এসে হতাশ হলো সে। শূন্য বেদি। ক্যাম্পারকে জিজ্ঞেস করলো, জলকন্যাটা কি বেচে দিয়েছেন?
না… দ্বিধা করলো ক্যাম্পার। কাল চুরি হয়ে গেছে। একজন খদ্দেরকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, তখন। ওটা কেন চুরি করলো বুঝলাম না। এর চেয়ে অনেক দামী জিনিস আছে এখানে।
হু, আনমনে বললো কিশোর।
দুনিয়ার যতো আজেবাজে লোক এসে হাজির হয় এই বীচে, বিরক্ত কণ্ঠে বললো ক্যাম্পার। কুত্তাটার কথাই ধরো। অহেতুক মেরে রেখে গেল ওটাকে।
সত্যিই গাড়ি চাপা পড়ে মরেছে কিনা তাই বা কে জানে, রবিন বললো। পুলিশ নাকি জানার জন্যে পোস্ট মর্টেম করতে নিয়ে গেছে।
তাই?
দীর্ঘ নীরবতা। ছেলেদের কথা শোনার অপেক্ষা করলো, যেন ক্যাম্পার। শেষে বললো, যদি তা-ই হয়…
বাধা দিয়ে কিশোর বললো, আচ্ছা, হোটেলে ঢোকেনি তো কিটু? জানালা খোলা ছিলো হয়তো, কিংবা দরজার তালা ভাঙা…
না, জোর দিয়ে বললো ক্যাম্পার। ভালোমতো আটকে রাখি আমি, যাতে বাইরের কেউ ঢুকতে না পারে। কখন কি নষ্ট করে ফেলে, না আগুনই লাগিয়ে দেয়, ঠিক আছে কিছু?
কাল পুলিশ ওখানে খুঁজেছিলো?
নিশ্চয়ই। তালা খুলে দিয়েছিলাম। ওরাও দেখেছে, বহুদিন ওখানে কেউ ঢোকেনি।
ভালোমতো খুঁজেছো তো?
রেগে গেল ক্যাম্পার। অনেক হয়েছে! কাজ আছে আমার। তোমাদের প্রশ্ন শেষ হয়ে থাকলে…
বেরিয়ে এলো ছেলেরা। কিন্তু ওরা অর্ধেক সিঁড়ি নামতেই পেছন থেকে ডাকলো ক্যাম্পার। রাগ পড়ে গেছে। দরজায় দাঁড়ানো মানুষটাকে এখন কেমন বয়স্ক আর বিধ্বস্ত লাগছে।
সরি, বললো সে, মেজাজ ঠিক রাখতে পারিনি। ছোটবেলায় আমার একজন বন্ধু হারিয়ে গিয়েছিলো। লাঞ্চের পরেও ক্লাসে এলো না। ওকে খুঁজতে বেরোলাম। আমিই খুঁজে পেয়েছিলাম। তখন আইওয়াতে থাকি। ওখানেই জন্মেছি আমি। ভালোমতো চিনি শহরটা। শহরের বাইরে পুরানো একটা গর্ত ছিলো। বৃষ্টির পানিতে ভরে গিয়েছিলো সেটা। দেখলাম, তাতে ভাসছে লাশটা।
বেচারা! জিভ দিয়ে চুকচুক করে দুঃখ প্রকাশ করলো কিশোর।
চত্বর ধরে এগোলো, ওরা। ক্যাফের বারান্দায় দেখা গেল মিস জেলড়া এমিনারকে। কফি খাচ্ছেন। ওদেরকে দেখেই বলে উঠলেন, এতো দেরি করলে! তোমাদের জন্যেই বসে আছি। এসো, একটা জিনিস দেখাবো।
০৬.
হেনরি লিসটারকে ডেকে আনলেন মিস এমিনার। বললেন, দুপুর হয়ে আসছে। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে ওদের। আমার সঙ্গে লাঞ্চ খাবে। চিকেন স্যাণ্ডউইচই দাও। আমাকে বাদ দিয়ে। আজকাল আর হজম করতে পারি না। বয়েস হয়ে গেছে। আর কি খাওয়ার মজা আছে!
স্যাণ্ডউইচ নিয়ে আসছি, বলে চলে গেল লিটার।
তোমাদের বয়েসে, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন মিস এমিনার, লোহা খেয়ে হজম করে ফেলেছি। টন কে টন পেনি ক্যাণ্ডি গিলেছি। লিকোরাইস হুইপ, টুটসি রোলস, কিছু বাদ দিতাম না। চেয়ারে সোজা হয়ে বসে দুঃখটা ঝেড়ে ফেললেন যেন তিনি। ভালো কথা, ক্যাম্পার কি বললো?
হঠাৎ এই প্রসঙ্গ পরিবর্তনে কিশোরও সোজা হয়ে বসলো।
নিনাকে সাহায্য করতে এসেছো তোমরা, তাই না? আবার বললেন মিস এমিনার। তোমাদেরকে যে ফোন করেছে, একথা সকালেই বলেছে আমাকে। আমারও অনুরোধ, ওর জন্যে কিছু করো। মেয়েটা খুব ভালো। এখানে ভালো লোকের বড় অভাব। বেশির ভাগই তো অসভ্য!
পেছন ফিরে তাকালেন মিস এমিনার। ভেজা কাপড় নিয়ে এসে টেবিল মুছতে লাগলো রাগবি ডিগার। উজ্জ্বল রোদে আরো বেশি রোগা লাগছে তাকে। গালে লাল লাল দাগ, সেগুলোর মধ্যে থেকে নারকেল গাছের জটলার মতো চুল গজিয়েছে খাড়া হয়ে। কনুয়ের কাছে আঠা আঠা কি যেন লেগে রয়েছে। অ্যাপ্রনের নিচে টি শার্টটা ময়লা।