নিজের বক্তৃতায় নিজেই সন্তুষ্ট হয়ে হাসলো ক্যাম্পার। দেখে নিও, একদিন এই ভেনিস একটা শহরের মতো শহর হবে। সবার মুখে মুখে ফিরবে এর নাম। পতিত জায়গাগুলো সব ঠিকঠাক হবে। গড়ে উঠবে নতুন নতুন বড়িঘর। দাম অনেক বেড়ে যাবে এই মারমেড কোর্টের।
ক্যাম্পার থামতেই কিশোর বলে উঠলো, সরাইখানাটার কি হবে? মেরামত করবেন?
এখনো মনস্থির করিনি। একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। হয়তো পুরোটাই ভেঙে। ফেলে নতুন করে গড়তে হবে। কিন্তু এটা একটা ইতিহাস, ভাঙতে মন চায় না।
খোলা দরজার দিকে তাকালো ক্যাম্পার। প্যারেড আসছে। ছেলেদের দিকে ফিরলো আবার। তা আর কিছু জানার আছে?
ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলো ওরা। বেরিয়ে যেতে বলা হচ্ছে ওদের। ক্যাম্পারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলো।
শূন্য চত্বর। সবাই গিয়ে ভিড় করেছে প্যারেড যেখানে হচ্ছে সেখানটায়। জোরে জোরে বাজছে এখন বাজনা। বাজনা না বলে হর্ন, ড্রাম আর বাঁশির কান ঝালাপালা করা মিশ্র শব্দ বললেই বোধহয় মানায় ভালো।
তিন গোয়েন্দাও এগোলো সেদিকে। সৈকতে বাজি পুড়ছে এখনও। ফাটছে। পটকা। শুরু হলো প্যারেড। আসলেই, ওরকম প্যারেড আর কখনো দেখেনি ওরা। ড্রাম বাজার তালে তালে ইস্কুলে দল বেঁধে যে রকম প্যারেড করে ওরা সে রকম। নয়। লোকে মার্চ করছে ঠিকই, তবে যার যার মতো করে। কেউ নির্দেশ দেয়ার নেই, নির্দেশ মানারও কেউ নেই। পোশাকও ইচ্ছে মতো পরেছে সবাই। শার্ট প্যান্ট তো বটেই, বেদিং স্যুট এমনকি শাড়িও পরেছে কেউ কেউ। কেউ পরেছে বিচিত্র আলখেল্লা, বুকের কাছে গোল গোল আয়না সেলাই করে লাগিয়ে নিয়ে। মোট কথা, যার যা পরনে আছে, তাই নিয়ে নেমে পড়া যায় ওই প্যারেডে।
খাইছে! বিড়বিড় করে বললো মুসা, কাণ্ড দেখেছো! মনে হয় ন্যাংটো হয়ে নেমে গেলেও কেউ কিছু মনে করবে না!
তার কথার জবাব দিলো না কেউ। রবিন ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত। কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে কিটুর দিকে। কয়েক ফুট দূরে মায়ের কাঁধে চড়ে প্যারেড় দেখছে। সেদিক থেকে মুখ ফেরাতে চোখে পড়লো, ওশন ফ্রন্টে তার প্রিয় বেঞ্চটায় গিয়ে। বসেছেন মিস্টার ডেজার।
বেশিক্ষণ কাঁধে থাকতে ভালো লাগলো না কিটুর। জোর করে নেমে পড়লো। মায়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় দিলো চত্বরের দিকে। এই, এই কোথায় যাচ্ছিস! চেঁচিয়ে ডাকলো নিনা। খদার, ক্যাম্পারের বাড়ির ধারেকাছেও যাবি না!
আচ্ছা। ফিরে তাকালো না কিটু। দৌড়ে চলে গেল। পেছনে গেল ডব।
প্যারেড চলছে। শুধু আজকের দিনের জন্যে ওশন ফ্রন্টে গাড়ি ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়েছে।– আরও কিছুক্ষণ পর, কিশোরের কানে এলো নিনা বলছে, কিটুটা গেল কোথায়?
মারমেড কোর্টের দিকে গেল নিনা। ফিরে এলো একটু পরেই। বাবা? ডাকলো সে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে।
বাবা, কোথায় তুমি?
বেরিয়ে এলেন হেনরি বোরম্যান।
বাবা, কিটুকে খুঁজে পাচ্ছি না!
আছে কোথাও, মেয়ের হাত চাপড়ে দিয়ে বললেন বৃদ্ধ। ডব আছে তো সঙ্গে?…কিছু হবে না।
কিন্তু মায়ের উদ্বেগ কাটলো না। শেষে মেয়েকে নিয়ে কোর্টের দিকে এগোলেন বোরম্যান, নাতিকে খোঁজার জন্যে।
ডেকে ডেকে সারা হয়ে গেল দুজনে, কিন্তু না মিললো কিটুর সাড়া, না দৌড়ে এলো ডব।
কোর্টের নিচতলার দোকানগুলোতে খুঁজলেন বোরম্যান। ব্যালকনিতে বেরিয়ে। এলো ক্যাম্পার। কাফের মালিক বেরিয়ে এলো তার দোকানের সামনের বেদিতে। কিটুর কথা জিজ্ঞেস করতে ঘাড় নাড়লো দুজনেই। দেখেনি।
এইবার ভয় ফুটলো নিনার চোখে। বাবা, আবার হারিয়েছে! হারিয়ে গেছে!
আহ, এতো অস্থির হোস কেন? সান্ত্বনা দিলেন বাবা। পাওয়া যাবেই।
আরেকবার কিটুকে খুঁজতে বেরোলো তিন গোয়েন্দা। আগের দিনের মতো করেই খুঁজতে শুরু করলো। তবে এদিন ভিড়ের কারণে খোঁজাটা ততো সহজ হলো না। মারমেড কোর্ট থেকে পাঁচ কি ছয় ব্লক দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেল ওরা। ধসে পড়া পুরানো একটা অ্যাপার্টমেন্টের ভাঙা সিঁড়িতে জিরিয়ে নিতে বসলো।
পেলাম না তো, রবিন বললো। হয়তো ফিরে গেছে। বইয়ের দোকানে, মায়ের কাছে। গিয়ে দেখা যাক, কি বলে?
চলো, উঠে দাঁড়ালো মুসা। খামোকাই বোধহয় প্যারেডটা মিস করলাম।
কিশোর কথা বলছে না। সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। অস্থির।
কি ভেবে উঠে দাঁড়ালো রবিন। এগিয়ে গেল বাড়িটার একপাশে। বড় একটা রাবিশ বিন দেখে উঁকি দিলো তার ভেতরে। চেঁচিয়ে উঠলো পরক্ষণেই, এই, জলদি দেখে যাও!
কি, কি হয়েছে! ছুটে গেল মুসা।
ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রবিনের মুখ। একটা কুকুর..ডব..মনে হয় মরে গেছে!
.
০৪.
বিকেল বেলা পুলিশ এলো কিটুকে খুঁজতে। সমস্ত ওশন ফ্রন্ট চষে ফেলা হলো, কিন্তু ছেলেটাকে পাওয়া গেল না।
পুলিশ যখন খুঁজছে, তখন মারমেড কোর্টে ক্যাফের বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছে তিন গোয়েন্দা। ওদের সঙ্গে রয়েছেন ডেজার। শেষ বিকেলে মিস এমিনার এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিলেন। বললেন, সাংঘাতিক কাণ্ড!
মহিলার কথায় শঙ্কা ফুটলো মুসার চোখে। বোধহয় ভূতের কথা মনে পড়ে গেছে। বিড়বিড় করে বললো, কিসে যে মারলো কুকুরটাকে! তবে আমার মনে হয় কিটু ভালোই আছে।
জোর দিয়ে বলা যায় না। সব সময় একসঙ্গে থাকতো দুজনে। ডবকে যে। মেরেছে তাকে নিশ্চয় দেখেছে কিটু। চিৎকার করেছে। হয়তো বাধা দেয়ারও চেষ্টা করেছে। আর সেটা করে থাকলে… কথাটা শেষ করলেন না তিনি, শুধু মাথা নাড়লেন।