ভুরু কোঁচকালো কিশোর। গল্পটা আমিও শুনেছি।
তা তো শুনবেই। হলিউডের অনেকেই জানে এই গল্প। নিরমার লাশ পাওয়া যায়নি। ফলে রঙ চড়িয়ে নানা গল্প বলতে লাগলো লোকে। কেউ বললো ভাসতে ভাসতে উপকূলের দিকে চলে গিয়েছিল ও। অ্যারিজোনার ফিনিক্সে গিয়ে উঠে ছিলো। তারপর থেকে বাস করছে ওখানকার এক পোলট্রি ফার্মে। কেউ বা বললো সাগর থেকে উঠে লুকিয়ে লুকিয়ে এসে আবার মারডেম ইনে ঢুকেছিলো নিরমা। একটা ঘরে আটকে রেখেছিলো নিজেকে। কারণ হঠাৎ জানতে পেরেছিলো, এক ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত হয়েছে সে। যে রোগের কথা জানলে আঁতকে উঠবে লোকে। মানুষের সামনে বেরিয়ে তাদের ঘৃণার পাত্র হতে চায়নি।
মিস এমিনার থামতেই ডেজার বললেন, লোকে বলে হোটেলে নাকি ভূতের উপদ্রব আছে। আর ভূতটা হলো নিরমা হল্যাণ্ডের। কথাটা আমিও বিশ্বাস করি।
দুর, কিসের ভূতটুত! হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলেন যেন মিস এমিনার।
কিছু একটা আছেই! জোর দিয়ে বললেন ডেজার। রাতে জানালায় আলো দেখেছি। কাউকে ঢুকতেও দেখা যায় না, বেরোতেও না। তারমানে ভেতরেই থাকে কেউ। ব্রড ক্যাম্পার হয়তো জানে ব্যাপারটা। সে জন্যেই তেমনি রেখে দিয়েছে হোটেলটা। মেরামত করে ঠিকঠাক কছে না।
কেন, ভূতের ভয়ে? জিজ্ঞেস করলো রবিন।
না, বিরক্তি দেখা দিলো মিস এমিনারের চোখে। হয়তো পাবলিসিটি চাইছে। যাও না, গিয়ে ওকেই জিজ্ঞেস করো না। গ্যালারিতে আছে।
ক্যাম্পারের রাগ দেখেছে রবিন। আমতা আমতা করে বললো, যাবো এখন?…তিনি হয়তো এখন ব্যস্ত।
কথা বলার সময় পাবে না, এতোখানি ব্যস্ত সে কোনো কালেই থাকে না, হঠাৎ রেগে গেলেন মিস এমিনার। লোকটাকে যে দুচোখে দেখতে পারেন না, বোঝা গেল। নিজের ঢাকঢোল পেটানোর সুযোগ পেলে আর কিছুই চায় না। গিয়ে খালি বলে দেখো না, ইস্কুলের ম্যাগাজিনে তার নাম ছাপবে। লাফিয়ে উঠবে। সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্যে।
ক্যাফের দিকে এগোলেন মিস এমিনার।
ডেজার হাসলেন। প্যারেড শুরু হতে দেরি আছে এখনও। কথা বলতে ইচ্ছে করলে যেতে পারো।
কোর্টের উত্তরে সিঁড়ির দিকে এগোলো ছেলেরা। একবার দ্বিধা করে লম্বা একটা দম নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আরম্ভ করলো রবিন। বদমেজাজী লোকটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছেও করছে, আবার সাহসও পাচ্ছে না। সমস্যাই বটে!
.
০৩.
মারমেড গ্যালারির উঁচু ছাত, সাদা দেয়াল। ছেলেরা ঢুকতেই কোথাও একটা ঘণ্টা বাজলো। চারপাশে তাকালো ওরা। উজ্জ্বল রঙের পর্দা। আবলুস আর রোজউড কাঠ কুঁদে তৈরি নানারকম চমৎকার ভাস্কর্য রয়েছে। আর আছে দেয়ালে ঝোলানো ছবি এবং কাঁচের সুদৃশ্য বাক্সে রাখা চীনামাটির তৈরি নানারকম সুন্দর সুন্দর জিনিস। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে রুপা কিংবা রঙিন কাঁচে তৈরি অনেক ধরনের ফুলদানী।
দরজার পাশে বিরাট জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে চীনামাটির তৈরি একটা তরুণী জলকন্যার মূর্তি। ফুট দুয়েক লম্বা। অর্ধেক-মানুষ-অর্ধেক-মাছ ওই কল্পিত জীবটি হাসছে। বেশ একটা খেলা খেলা ভাব। মাছের লেজের ওপর ভর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুহাতে ধরে রেখেছে একটা সাগরের ঝিনুক।
কি চাই? তপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ব্রড ক্যাম্পার। কোমর সমান উঁচু একটা। কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট একটা ভাড়ার ঘরমতো করা হয়েছে ওখানটায়। একটা সিংক আছে, ক্যাবিনেট আছে। ব্রাশ আর ঝাড়ু রাখার আলমারিটা রাখা হয়েছে ঘরের ডান কোণ ঘেঁষে।
আবার দ্বিধা করলো রবিন, একবার ভাবলো বেরিয়েই যায়। লোকটার গোমড়া মুখ দেখেই বুকের মধ্যে কেমন করছে তার।
কিন্তু কিশোর এগিয়ে গেল ভারিক্কি চালে। পরিচয় দিলো, আমি কিশোর পাশা। কাল দেখা হয়েছিলো আমাদের। কিটুদের বইয়ের দোকানে আপনার কথা অনেক শুনেছি, তাই দেখা করতে এলাম।
তার শেষ কথাটায় অনেকখানি নরম হলো ক্যাম্পার। সেটা বুঝতে পেরে ভরসা পেলো কিশোর। রবিনকে দেখিয়ে বললো, আমার বন্ধু রবিন মিলফোর্ড। ইস্কুলের ম্যাগাজিনে একটা আর্টিকেল লিখবে। তথ্য দরকার। আমরা শুনলাম, ভেনিসের একজন বিশিষ্ট লোক আপনি।
অ্যাঁ! হ্যাঁ, তা ঠিক, দেয়ালের ধারে রাখা কয়েকটা চেয়ার দেখালো ক্যাস্পার। তা বসো না তোমরা, দাঁড়িয়ে কেন? একেবারে বদলে গেছে। নিজেও একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে, খুব সতর্কভাবে শব্দ চয়ন করে ভেনিস সম্পর্কে বলতে শুরু করলো, বহুদিন থেকেই মারমেড কোর্টের ব্যাপারে ইনটারেস্টেড ছিলাম আমি। ভেনিসে সাঁতার কাটতে আসতাম। সাইকেল চালানোর রাস্তাও তখন ছিলো না এখানে। সৈকতের ধারে ছোট ছোট কয়েকটা বীচ হাউস ছিলো, প্রায় ধসে গিয়েছিলো ওগুলো। খালের পাড় আগাছায় ভর্তি।
এই সময় একদিন শুনলাম মারমেড ইন বিক্রি হবে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, দাম। খুব বেশি না, আমার সামর্থ্যের মধ্যেই। সামনের জায়গাটা সহ কিনে ফেললাম হোটেলটা। ছোটবেলায় নিরমা হল্যাণ্ডের ভক্ত ছিলাম আমি। হোটেলটা কিনে খুব ভালো লাগলো। মনে মনে গর্ব হতে লাগলো-আমার প্রিয় অভিনেত্রী যেখানে তার শেষ রাতটা কাটিয়েছেন, সেটার মালিক হতে পেরেছি আমি।
এক এক করে তিন কিশোরের মুখের দিকে তাকালো ক্যাম্পার। নিরমা হল্যাণ্ডের কথা নিশ্চয় জানো?
জানি, মাথা ঝাঁকালো রবিন।
জায়গাটা যখন কিনেছিলাম, ক্যাম্পার বললো, শুধু সরাইখানা আর সামনে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া একটা চত্বর ছাড়া আর কিছু ছিলো না এখানে। দুপাশের নতুন বিল্ডিং দুটো আমি বানিয়েছি। সামনের জায়গাটা আমি সাজিয়েছি। থাকবোই যখন ঠিক করেছি, একটু গোছগাছ করে না নিলে কি চলে। আর করেছি বলেই তো। আবার লোকজন আসতে আরম্ভ করেছে। অনেক গণ্যমান্য লোক আছে তাদের মধ্যে।