মিস্টার ক্যাম্পার ওটার মালিক, ডেজার জানালেন। মারমেড কোর্ট আর হোটেলটাও তারই। গ্যালারির পাশে ওই যে, বইয়ের দোকানের ওপরের অ্যাপার্টমেন্টটায় থাকেন।
চত্বরের অন্যান্য বাড়িগুলোর দিকে নজর ফেরালো এবার ওরা। চত্বরের পুরো পুব প্রান্ত জুড়ে রয়েছে মারমেড ইন। দক্ষিণে রয়েছে আরও কিছু দোতলা বাড়ি। নিচতলায় দোকান, ওপরতলায় বাসা। হোটেলের গাঁ ঘেষে রয়েছে বড় একটা কাফে, নাম ওশন ফ্রন্ট স্ন্যাকস। আর সৈকতের শেষে পানির একেবারে ধার ঘেঁষে। রয়েছে আরেকটা দোকান। উয়েয়ার সামথিং এটার নাম। সুতা, উল থেকে শুরু করে সেলাই আর বোনার যাবতীয় সরঞ্জাম পাওয়া যায় এখানে।
খোয়া বিছানো রাস্তা, ফোয়ারা, ঘাসের চাপড়া আর ফুলের টব দিয়ে সুদৃশ্য করে সাজানো হয়েছে চত্বরটা। কাফের সামনে সিমেন্টে বাঁধানো এক বিশাল বেদির মতো উঁচু জায়গা, ছোটখাটো চত্বরই বলা চলে ওটাকে। তাতে চেয়ার-টেবিল সাজানো। শুকনো, রোগা, কালো চুলওয়ালা একজন মানুষ ঘুরে ঘুরে টেবিল থেকে এঁটো বাসন-পেয়ালাগুলো তুলে নিয়ে রাখছে একটা ট্রেতে। দেখে মনে হয়, বহুদিন ঘুম কিংবা গোসল কপালে জোটেনি তার। ওখানেই দেখা গেল কিটুকে। বেদির ওপর উঠে কিনারে গিয়ে লাফ দিয়ে নিচে পড়ছে। আবার উঠছে, আবার পড়ছে। কাছে বসে খুদে বন্ধুর খেলা দেখছে ডব, আর নীরব ভাষায় বাহবা দিচ্ছে যেন।
এই ছেলে! হঠাৎ ধমক দিয়ে বললো রোগাটে লোকটা, অনেক হয়েছে! থামো এবার!
মন খারাপ হয়ে গেল কিটুর। বেদি থেকে নেমে বইয়ের দোকানের দিকে রওনা। হলো।
অতোটুকুন একটা ছেলের সঙ্গে ওরকম ব্যবহার করলো! লোকটার আচরণ ভালো লাগেনি মুসার। কি এমন ক্ষতি করে দিচ্ছিলো?
ভদ্রতা এখনও শেখেনি, ডেজার বললেন। ওর নাম রাগবি ডিগার। লোকটোক না পেয়ে শেষে ওকেই রেখেছে হেনরি আর শেলি লিসটার। কাফেটা ওদেরই।
ওই বাড়িটাও কি মিস্টার ক্যাম্পারের? রবিন জানতে চাইলো।
হ্যাঁ। দেখছো না দুপাশের বাড়িগুলো নতুন। শুধু মাঝের সরাইখানাটা। পুরানো। উনিশশো বিশ সালে যখন এখানে সবে বসতি শুরু হয়েছিলো তখনকার তৈরি। শহরটার নাম যে ভেনিস রাখা হয়েছে তার কারণও আছে। ইটালির ভেনিসের মতোই এখানেও রয়েছে প্রচুর খাল। আর এগুলো দেখতেই আগে অনেক লোক আসতো এখানে। ছুটির দিনে দলে দলে আসতো হলিউড থেকে। মারমেড ইনে উঠতো তারা, খাল দেখতো, সাগরে সাঁতার কাটতো। তারপর ধীরে ধীরে এখানকার আকর্ষণ কমে গেল লোকের কাছে। পয়সাওয়ালারা চলে যেতে লাগলো মালিবুতে। শেষে লোকজন আসা প্রায় বন্ধই হয়ে গেল একসময়। লালবাতি জ্বললো সরাইখানাটার। জায়গাটা তখন ব্রড ক্যাম্পার কিনে নিয়ে দুপাশে নতুন বাড়ি তুললো। আমরা ভেবেছিলাম পুরানো বাড়িটারও সংস্কার করবে। কিন্তু কিছুই করলো না। হাতই দিলো না ওটাতে।
ব্রড ক্যাম্পার! হঠাৎ তুড়ি বাজালো কিশোর। চিনেছি! কাল দেখেই চেনা। চেনা লেগেছিলো, মনে করতে পারছিলাম না। এখন মনে পড়েছে। অভিনেতা।
কই, নামও তো শুনিনি কখনও, মুসা বললো।
হ্যাঁ, অভিনেতাই ছিলো ক্যাম্পার, কিশোরের কথায় সায় জানিয়ে বললেন ডেজার। অনেকদিন হলো অভিনয় ছেড়ে দিয়েছে, তোমাদের জন্মেরও আগে থেকে। কিশোর, তুমি চিনলে কি করে? টেলিভিশনে দেখেছো?
সিনেমার পোকা ও, হেসে বললো রবিন। হলিউডের ছোট থিয়েটারগুলোতে। পুরানো ছবি দেখতে যায় মাঝে মাঝেই।
মুচকি হাসলো মুসা। ও নিজেও অভিনয় করেছে এক সময়। মোটুরাম।
চোখ কপালে উঠলো ডেজারের। মাই গুডনেস! তুমিই মোটুরাম! ভালো, ভালো, খুব ভালো! ইউ আর আ জিনিয়াস!
রক্ত জমলো কিশোরের মুখে। অতীতের এই নামটা শুনতে একটুও ভালো লাগে না তার। টিভি সিরিয়াল পাগল সংঘ-তে ওই নামে অভিনয় করেছিলো, এই স্মৃতি মনে পড়লেই তেতো হয়ে যায় মন। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যে। বললো, গ্যালারিটা তাহলে ব্রড ক্যাম্পারই চালায়?
হ্যাঁ। ছবি, চীনামাটি আর রুপার তৈরি নানা রকম জিনিস, এসব বিক্রি করে।
কাফে আর উয়েয়ার সামথিঙের ওপরে একটা ব্যালকনি দেখালেন ডেজার। দুটো অ্যাপার্টমেন্ট আছে ওখানে। একটাতে আমি থাকি। আর ওই যে সাগরের দিকে মুখ করা, ওটাতে থাকে মিস জেলড এমিনার। খুব ভালো মহিলা।
মিস্টার ডেজারের পড়শীর বয়েস সত্তর। ব্যালকনি থেকে সিঁড়ির রেলিং বেয়ে। আস্তে আস্তে নেমে আসতে লাগলেন। পরনের গাউনটা বর্তমান ফ্যাশনের তুলনায় অনেক বেশি ঢোলা। ঝুলও বেশি। হ্যাঁটের চারপাশে বসানো কাপড়ের তৈরি লাল গোলাপ।
গুড মরনিং মিস এমিনার, ডেজার বললেন। আসুন। এরা আমার ইয়াং ফ্রেণ্ড। একে একে নাম বলে বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি।
কিশোর পাশা! উচ্চারণটা ঠিকমতো করতে পারলেন না মহিলা। চমৎকার। নাম তো! ওরকম শুনিনি।
ও বাংলাদেশী। বুঝিয়ে বললেন ডেজার, একটা কাজে এসেছে এখানে। রিসার্চ ওঅর্ক। ভেনিস সম্পর্কে লিখবে ইস্কুলের ম্যাগাজিনে।
ভেনিস? নাকি শুধু মারমেড কোর্ট?
অবাক হলো রবিন। মারমেড কোর্টেই এতো কিছু জানার আছে নাকি?
অনেক, অনেক, মিস এমিনার বললেন। এই মারমেড ইন থেকেই নিরমা। হল্যাণ্ড নিখোঁজ হয়েছিলো।
শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো রবিন আর মুসা।
অনেক দিন আগের কথা, তাই না? ডেজারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন মিস এমিনার। জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন, তখন ভেনিসের খুব জমজমাট অবস্থা। এখানে প্রায়ই থাকার জন্যে আসতো নিরমা। এক রোববারে সকালে উঠে সাঁতার কাটতে বেরিয়েছিলো। তারপর থেকে গায়েব, আর দেখা যায়নি।