চমকে উঠলো মুসা, গুলি নাকি?
না, বাজি, বললো কিশোর।
গুলির মতোই লাগলো। প্যারেডের হট্টগোল শুরু হয়ে গেল তাহলে।
কংক্রীটের চত্বরটা লোকে বোঝাই। নানা রকম মানুষের ভিড়। ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছেলেমেয়ের দল। অসংখ্য ছাতার নিচে গিয়ে ঠাই নিয়েছে। বুড়োরা। আইসক্রীম খাচ্ছে। ছোট ঠেলাগাড়িতে করে শিশুদের ঠেলে নিয়ে চলেছে মায়েরা। তাদের কারো কারো পায়ে পায়ে রয়েছে কুকুর-এক কিংবা একাধিক। বাজনা বাজিয়ে লোকের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করছে স্ট্রীট মিউজিশিয়ানরা। একটা ভ্যানের পেছন থেকে কাপড়ে তৈরি বিচিত্র সব জিনিস নামাচ্ছে কয়েকজন বিচিত্র পোশাক পরা মানুষ।
সঙ্গে ক্যামেরা এনেছে রবিন। একের পর এক ছবি তুলছে। লাল গাউন পরা। মিস লিয়ারি গুনকে দেখে তার ছবি তুললো। অ্যাকর্ডিয়ন বাজাচ্ছে একটা লোক। দুই কাঁধে বসে আছে উজ্জ্বল রঙের দুটো কাকাতুয়া। আর বাজনার তালে তালে নাচছে মেয়েটা।
পানির দিক থেকে ঠেলাগাড়ি ঠেলে আনছে একজন লোক। গাড়িটাতে বোঝাই বোতল আর ক্যান। তার পেছন পেছন আসছে দুটো নেড়ি কুকুর। যেখানে সেখানে। কোকাকোলা আর লেমোনেডের খালি বোতল ছুঁড়ে ফেলছে লোকে। লোকটা সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আবর্জনা ফেলার জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলে আসবে। গাড়ি থামিয়ে বোতল বা ক্যান তোলার জন্যে লোকটা থামলেই বাধ্য ছেলের মতো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে কুকুর দুটো।
ওর নাম বরগু, ছেলেদের পেছন থেকে বলে উঠলো একটা কণ্ঠ। ফিরে তাকিয়ে দেখলো ওরা, মিস্টার ডেজার কথা বলছেন। খুব ভালো মানুষ। এরকম কমই দেখা যায়। কারো সাতেপাচে নেই, নিজের মতো থাকে। কষ্ট করে যা রোজগার করে, কুকুর দুটোর সঙ্গে ভাগাভাগি করে খায়। ভালো, সত্যি ভালো লোক, শেষের বাক্যটা মাথা নেড়ে বললেন তিনি।
বরগুকে দেখতে লাগলো ছেলেরা। গাড়িটা ঠেলে নিয়ে গিয়ে এক জায়গায় রাখলো লোকটা। তারপর সৈকতের একটা কাফের সামনে পাতা একটা বেঞ্চিতে বসলো। পকেট থেকে বের করলো একটা হারমোনিকা। তার দিকে মুখ করে কুকুর দুটো বসলো পায়ের কাছে। বাজনা শোনার আশায় খাড়া করে ফেলেছে কান।
বাজাতে আরম্ভ করলো বরগু। শুরুটা হলো খুব নিচু খাদ থেকে। মোলায়েম সুর, চড়তে লাগল ধীরে ধীরে। তারপর অবাক কাণ্ড! একটা দুটো করে ছেলে মেয়েরা আসতে লাগলো। ঘিরে বসলো তাকে।
অপরিচিত সুর। ভারি মিষ্টি। কান পেতে শুনছে তিন গোয়েন্দা। ভালো লাগছে ওদের। বাচ্চাদেরও লাগবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
মাত্র কয়েক মিনিট বাজিয়েই উঠে পড়লো বরগু। হারমোনিকা পকেটে ভরে আবার চললো তার ঠেলাগাড়ির দিকে। কুকুর দুটো চুলোে তার পেছনে। নিতান্ত নিরাশ হয়েই যেন উঠে পড়ে আবার যার যার মতো চলে গেল ছেলেমেয়েরা।
সব সময়ই এরকম হয়? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। বাচ্চারা ছুটে আসে?
সব সময়, জবাব দিলেন ডেজার। বরগুর নাম রেখেছি আমরা ভেনিসের বংশীবাদক। হ্যাঁমিলনের সেই বাঁশিওয়ালার মতোই বাঁশি বাজিয়ে বাচ্চাদের টেনে নিয়ে আসার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার।
হাঁটতে শুরু করলো আবার তিন গোয়েন্দা। ওদের সঙ্গী হলেন ডেজার। প্রচুর বাজি-পটকা পোড়ানো হচ্ছে সৈকতের ধারে। চত্বরের ওপরে উড়ে এসেও ফাটছে দু-একটা। ওরা বইয়ের দোকানের কাছাকাছি হতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। কিটু। নজর সামনের চত্বরে জনতার ভিড়ের দিকে। ডবও রয়েছে তার সঙ্গে। পা বাড়ালো ছেলেটা। কুকুরটা ছায়ার মতো সেঁটে রইলো তার সঙ্গে। হাঁটার আড়ষ্টতা দেখেই বোঝা যায় অনেক বয়েস। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে।
আবার দেখি একা একা বেরোলো ছেলেটা, মুসা বললো।
অসুবিধে নেই, ডেজার বললো। ডব রয়েছে সঙ্গে…
বাধা দিয়ে রবিন বললো, ছেলেটা এরকমই করে নাকি…কালকের মতো…
করে। একদণ্ড স্থির থাকতে পারে না। বলে বলে হদ্দ হয়ে গেছে তার মা। কিছুতেই কথা শোনাতে পারে না। দোকানে থাকতেই চায় না কিটু। বেরিয়ে যায় কুকুরটাকে নিয়ে। সারা সৈকতে ছোটাছুটি করে। খেলে বেড়ায়। তবে হারিয়ে যায় না। ডব সঙ্গে থাকলে কোনো ভয় নেই। ওর মা বলেছে, এই সেপ্টেম্বরেই ইস্কুলে ভর্তি করে দেবে। দুষ্টুমি অনেক কমবে তখন।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো মুসা। সময়ই পাবে না দুষ্টুমি করার।
সব ব্যাপারেই যেন দ্রুত আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে ছেলেটা। প্যারেডের কোন কিছুই তাকে ধরে রাখতে পারলো না। ভিড় থেকে সরে গিয়ে চত্বরের একধারে। একটা বাড়ির দেয়ালের গায়ে বল ছুঁড়ে খুঁড়ে খেলতে শুরু করলো। বাড়িটা অনেক পুরানো। তিনতলা। দুই পাশে নতুন গড়ে ওঠা দোকানপাটগুলো ওই প্রাচীনতার সঙ্গে কেমন যেন বেমানান।
বেশ পুরানো, রবিন বললো। ডেজারকে জিজ্ঞেস করলো, ইতিহাস টিতিহাস আছে নাকি এটার?
নিশ্চয় আছে। ওটার নাম মারমেড ইন..।
জলকন্যা! বাংলায় বিড়বিড় করলো কিশোর।
অ্যাঁ! কি বললে?
না, কিছু না।
আবার আগের কথার খেই প্রলেন ডেজার, ওটার নামেই চত্বরটার নাম রাখা হয়েছে, মারমেড কোর্ট। আগে বাড়িটা সরাইখানা ছিলো। ভেনিস সম্পর্কে লিখতে গেলে ওটার কথা অবশ্যই লিখতে হবে তোমাকে। ছবি তুলে নাও।
ছবি তুলতে লাগলো রবিন। কিশোর আর মুসা ভালো করে দেখতে লাগলো চত্বরটা, আগের দিন দেখার সুযোগ পায়নি। পশ্চিম দিকে খোলা, পুরানো হোটেলটা থেকে স্পষ্ট চোখে পড়ে সাগর। কোর্টের উত্তরে লম্বা একটা দোতলা বাড়ি, নিচতলায় দোকানপাট। এটাতেই রয়েছে রীডারস হেভেন। একটা ঘুড়ির দোকান। আছে, নাম ব্লু স্কাই। ওটার পাশে আরেকটা ছোট দোকানের নাম হ্যাপি বাইইং। জানালার কাছে শো কেসে সাজানো রয়েছে নানা রকম রঙিন পাথর, খনিজ দ্রব্য আর রুপার তৈরি নানা রকম অলঙ্কার। হোটেল আর এই দোকানটার মাঝের কোণ থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে আরেকটা দোকানের প্রবেশপথের কাছে। ওটার নাম। মারমেড গ্যালারি, ঠিক হ্যাপি বাইইঙের ওপরে।