রাস্তায় হচ্ছে শব্দটা, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুসা। জানালা ঢেকে রাখা তক্তায় ঠেলা দিলো। বড় হলো ফাঁক। সেখান দিয়ে তাকাতে চোখে পড়লো সরু একটুকরো চত্বর, স্পীডওয়ের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। সরাইখানার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে একটা লরি। ময়লা ফেলার গাড়ি ওটা। বিরাট একটা ইস্পাতের দাঁড়া নেমে আসছে চাবি টিপলেই, রাবিশ বিনকে চেপে উপরে তুলে নিয়ে গিয়ে খোলা মুখটা কাত করে ধরছে, ময়লা-জজ্ঞাল সমস্ত ট্রাকের পেছনে তুলে নিয়ে আবার মাটিতে নামিয়ে রাখছে বিনটা। বিন ওপরে ভোলার সময়ই বিকট গোঙানির মতো শব্দ করছে মেশিন।
দূর! হতাশ হয়েছে কিশোর। ময়লা ফেলার গাড়ি!
মাথা ঝাঁকালো ক্যাম্পার। পুরানো আর বদ্ধ জায়গা বলেই শব্দটা বেশি। হচ্ছে।
সেলরিটা খুঁজে দেখতে বেশিক্ষণ লাগলো না। নিরাশ হয়ে আবার রান্নাঘরে ফিরে এলো তিন গোয়েন্দা।
নিচতলায় কিটু নেই। দোতলায় উঠলো ওরা। ঘরে ঘরে সেই একই রকম শূন্যতা, ধুলো মাকড়সার জাল আর ইঁদুর।
একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো ক্যাম্পার। ঘরটার নাম রাজকন্যের। স্যুইট। অনেকবার ঢোকার চেষ্টা করেছি। চাবিও আছে, কিন্তু কিছুতেই তালা, খুলতে পারিনি। মরচে পড়ে বোধহয় আটকে গেছে তালাটা। দরজা না ভেঙে আর ঢোকা যাবে না। সাধারণ দরজা হলে ভেঙে ফেলতাম, কিন্তু সুন্দর পাল্লাটা ভাঙতে। মন চায় না।
সত্যিই সুন্দর। নানারকম সামুদ্রিক জীব আঁকা রয়েছে, চারপাশে জলজ আগাছা এঁকে করা হয়েছে অলঙ্করণ। ঠিক মাঝখানে আঁকা একটা জলকন্যার হাসিমুখ।
গ্যালারিতে যে মারমেডটা ছিলো, ক্যাম্পার জানালো, ওটা আগে ছিলো। নিচতলার লবিতে। ইস, এটাকেও যদি নষ্ট না করে খুলে নিয়ে যেতে পারতাম!
চেষ্টা করলে পারতেও পারেন, কিশোর বললো। সত্যিই কি এই ঘরটায় কখনও ঢোকেননি?
না। ভেনিসে এলে এটাতেই থাকতো নিরমা হল্যাণ্ড।
এখানেই ভূত দেখা যায়? মুসার প্রশ্ন।
হাসলো ক্যাম্পার। ওসব গালগল্প বিশ্বাস করো নাকি? আমি করি না। লোকে কতো কিছুই তো বানিয়ে বলে। সব ফালতু।
এরপর তিনতলায় উঠলো ওরা। জানালা দরজা বেশির ভাগই খোলা। ক্যাম্পার বললো, মাটি থেকে তিরিশ ফুট ওপরে। এখানে উঠতে পারবে না। ও। অসম্ভব।
চিলেকোঠা আছে? কিশোর জানতে চাইলো।
না।
আশা নেই তবু খুঁজলো গোয়েন্দারা। কিটুর কোনো চিহ্নই পাওয়া গেল না। এককোণ থেকে একটা শ্যাফট নেমে গেছে নিচের ভাড়ার ঘরে।
এটাকে বলে ডামবওয়েইটার শ্যাফট, বুঝিয়ে বললো ক্যাম্পার। রান্নাঘর থেকে এটা দিয়ে খাবার সরাসরি ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।
শ্যাফটটা শূন্য। ক্যাম্পার জানালো, টর্চ দিয়ে ভালমতো এটার ভেতরে খুঁজে দেখছে পুলিশ।
নিচতলায় নেমে এলো আবার ওরা। গ্যালারিতে ঢুকলো। ক্যাম্পারকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে, রোদে। চত্বরে দেখা গেল নিনা হারকারকে। চোখ বসে গেছে, রোগা হয়ে গেছে শরীর। গোয়েন্দাদের দেখে বললো, ওখানে খুঁজতে গিয়েছিলে তো? নেই আমি জানি। এ-ও জানি, ওর কি হয়েছে। স্পীডওয়েতে চলে– গিয়েছিলো, কিংবা আরও দূরে। গাড়ি এসে চাপা দিয়ে কুকুরটাকে মেরে ফেলে। বকা শোনার ভয়ে আরও দূরে চলে গিয়েছে কিটু, তারপর আর পথ চিনে ফিরে আসতে পারেনি। এটাই হয়েছে। থামলো একটু, তারপর বললো, টেলিভিশন দেখে কিংবা বই পড়ে সে অনেক কিছু করতে চাইতো। গত হপ্তায় কি ছবি দেখেছে জানো? পুরানো একটা সিনেমা, দ্য লিটল ফিউজিটিভ।
হু? বলে উঠলো ক্যাম্পার। ছেলেদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কানে গেছে নিনার কথা।
হ্যাঁ। একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে গল্প। ছেলেটার মনে হয়েছে, তার ভাইকে সে খুন করেছে। ফলে কনি আইল্যাণ্ডে পালিয়েছে সে। কিটুও ওরকম করেই পালিয়েছে। ভেনিস পিয়ারে খুঁজেছে পুলিশ। পায়নি। তারমানে অন্য কোথাও লুকিয়েছে।
ঠিক বলেছো, নিনা, জোর গলায় বললো ক্যাম্পার। যাবে কোথায়? না। খেয়ে কদিন থাকবে? খিদে সহ্য করতে না পেরে সুড়সুড় করে বাড়ি ফিরে আসবে।
গ্যালারিতে ফিরে গেল ক্যাম্পার।
কিন্তু খিদে আর কতো সহ্য করবে? কাদো কাদো গলায় বললো নিনা, দুদিন তো হয়ে গেল। চোখের পানি মুছে ঘুরলো। পা টেনে টেনে এগোলো বুকশপের দিকে।
মারমেড় গ্যালারির দিকে ফিরলো মুসা। গ্যালারি বন্ধ করে দিয়েছে ক্যাম্পার, দরজায় ঝুলিয়ে দিয়েছে CLOSED লেখা সাইনবোর্ড।
গেছে কোথাও, মুসার দৃষ্টি অনুসরণ করে বললো কিশোর। নিনার গল্পটা নাড়া দিয়েছে তাকে। ওর মুখ দেখেছিলে, কি রকম বদলে গিয়েছিলো?
বেশি দূর যেতে পারেনি নিশ্চয়, রবিন বললো। দৌড় দিলো ওশন ফ্রন্টের দিকে। চত্বরের উত্তর দিকটা দেখে ফিরে এলো একটু পরেই। গ্যালারির পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নামছে। জলদি এসো।
ঘুরে মারমেড ইনের পেছনে চলে এলো ওরা। গ্যারেজ থেকে জাগুয়ারটা বের। করে ফেলেছে ক্যাম্পার।
খাইছে! গাড়ি! ফলো করবো কি করে? হাত নাড়লো মুসা।
এসো, পারবো, বলে অল্পীডওয়ের দিকে ছুটলো কিশোর। রোলস রয়েসটা। এসে গেছে। ওদের পাশে এসে ব্রেক কষলো হ্যানসন। বললো, যাবেন কোথাও…
তার কথা শেষ হলো না। একটানে পেছনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। কিশোর। জাগুয়ারটা দেখিয়ে বললো, ওটাকে ফলো করুন।
রবিন আর মুসাও উঠে বসেছে।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে জাগুয়ারের পেছনে লাগলো হ্যানসন।