নিজেদের পরিচয়, অর্থাৎ নাম বললো তিন গোয়েন্দা। কিটুর মা-ও তার পরিচয় জানালো। পুরো নাম নিনা হারকার। ছেলেকে ফিরে পেয়ে উৎকণ্ঠা দূর হয়ে গেছে। হঠাৎ তাই হালকা হয়ে গেল মেজাজ। ছেলেদেরকে নিয়ে চলে এলো সেই চত্বরে, যেখানে খানিক আগে গল্প করছিলো তিন গোয়েন্দা। চত্বর দিয়ে ঘিরে ইংরেজী U অক্ষরের মতো করে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো পাকা বাড়ি। ইউ-র দুই প্রান্তে বেশ কিছু দোকানপাট। বয়ের প্রথম দোকানটার দিকে এগোলো নিনা। বইয়ের দোকান ওটা, নাম রীডারস হেভেন।
ভেতরে খরচের খাতা দেখছেন বছর ষাটেকের এক বৃদ্ধ। নাম হেনরি বোরম্যান। পরিচয় করিয়ে দিলো নিনা। ভদ্রলোক তার বাবা। দুজনে মিলে বইয়ের দোকানটা চালায়।
মায়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার কাছে শুয়ে থাকা একটা বিশাল কুকুরের দিকে এগিয়ে গেল কিটু। ওটার নামই ডব, বুঝতে অসুবিধে হলো না গোয়েন্দাদের। ডবের ধমনীতে বইছে মিশ্র রক্ত। বাবার জাত গ্রেট ডেন, মা লাব্রাডর। কিটুকে এগোতে দেখে নড়েচড়ে উঠে বসলো, থুতনি রাখলো ছেলেটার কাঁধে।
দেখছিস কি রকম করছে! নিনা বললো। ওকে ফেলে যেতে লজ্জা করে না তোর?
ও ঘুমোচ্ছিলো। কারো ঘুম ভাঙানো কি ঠিক?
বড় বড় কথা শিখেছে! আরেক দিন ওরকম করে কোথাও যাবি তো বুঝবি মজা।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার ডেজার। কাঁধ দিয়ে তাকে ঠেলে সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো মাঝবয়েসী একজন লোক। চেহারাটা ভালোই, কিন্তু পাথরের মতো কঠিন করে রেখেছে। চোখ গরম করে কিটুর দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললো, টুথপেস্ট দিয়ে আমার জানালায় তুমি ছবি এঁকেছো?
জবাব না দিয়ে ডবের পেছনে সরে গেল কিটু।
কিটু! ভীষণ রেগে গেল নিনা। এতো শয়তান হয়েছিস তুই।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন বোরম্যান। তাই তো বলি, আমার টুথপেস্টের কি হলো! ৬-জলকন্যা
আবার যদি এরকম করো, পুলিশের কাছে যাবো বলে দিলাম, হ্যাঁ! হুমকি দিলো আগন্তুক।
সরি, মিস্টার ক্যাম্পার, ছেলের হয়ে মাপ চাইলো মা, আর ওরকম হবে না…
না হলেই ভালো। এতো লাই দিলে ছেলে মাথায় উঠবেই। একটু-আধটু শাসন দরকার।
তার খুদে মনিবকেই গালমন্দ করা হচ্ছে, এটা বুঝে গেল ডব। ব্যাপারটা পছন্দ হলো না তার। চাপা গরগর করে উঠলো।
এই কুত্তা, চুপ! ধমক দিয়েই বুঝলো ক্যাম্পার, ভুল করে ফেলেছে। জ্বলে। উঠেছে বিশাল কুকুরটার চোখ। দোকান থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল সে।
মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসি মুছে গেল কিটুর। মা হাসছে না। এমনকি নানাও না। কুকুরটার পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরলো সে।
হয়েছে, আর মুখ ওরকম করতে হবে না! খেঁকিয়ে উঠলো নিনা। দেখো না, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না! লোক আর পাসনি, বাড়িওলার জানালায় গেছিস ছবি আঁকতে। ঘাড়টি ধরে যখন বের করে দেবে তখন বুঝবি।
চুপ করে রইলো কিটু। তারপর উঠে রওনা দিলো দোকানের পেছন দিকে। একটা টেবিলের নিচে কিছু খেলনা পড়ে আছে, সেদিকে। সঙ্গী হলো ডব।
সেদিকে তাকিয়ে আনমনে বিড়বিড় করলো নিনা, মিনিট পনেরো শান্ত থাকলে হয়। কি ছেলেরে বাবা!
কিটুকে খুঁজে বের করে দেয়ার জন্যে আরেকবার তিন গোয়েন্দাকে ধন্যবাদ দিলো নিনা। তার বাবা এক বোতল করে সোডা খেয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। খুশি হয়েই তাতে সায় দিলো ছেলেরা। কারণ এই অঞ্চলে কাজ আছে ওদের। আমেরিকান সভ্যতার ওপর গবেষণা করতে এসেছে রবিন, ইস্কুলের ম্যাগাজিনে লিখবে। তাকে সাহায্য করছে কিশোর আর মুসা।
শহর এলাকার কথাই বেশি লিখবো, বোরম্যানকে জানালো রবিন। যেসব জায়গার পরিবর্তন খুব বেশি হচ্ছে। ভাবছি ভেনিস থেকেই শুরু করবো।
মাথা ঝাঁকালেন বোরম্যান।
আনন্দে টেবিলে থাবা মারলেন ডেজার। ঠিক জায়গায় এসেছে! কেবলই বদলাচ্ছে ভেনিস, সেই গড়ে ওঠার পর থেকেই। এতো বিভিন্ন ধরনের লোকের আনাগোনা এখানে পরিবর্তনটা হচ্ছেই সে-কারণে।
কালকে প্যারেড দেখতে আসছো তো? নিনা জিজ্ঞেস করলো।
নিশ্চয়ই, রবিন বললো। ফোর্থ অভ জুলাই প্যারেডের কথা অনেক শুনেছি। সুযোগ যখন পেলাম, না দেখে কি আর ছাড়ি।
হ্যাঁ, দেখারই মতো, বোরম্যান বললেন। এরকম প্যারেড আর কোথাও হয় না। তবে গণ্ডগোল হয় ভীষণ। যাচ্ছে তাই কাণ্ড ঘটে যায়।
চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে বন্ধুদের দিকে তাকালো রবিন। জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। লাল স্কার্ট পরা এক তরূণী হেঁটে যাচ্ছে, তাকেই দেখছে গোয়েন্দা সহকারী। তরুণীকে উদ্দেশ্য করে কি যেন বলছে এক বখাটে ছোকরা। চোখের পলকে ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো মেয়েটা। সোজা গিয়ে ঠাস করে এক চড় কষিয়ে দিলো ছোকরার গালে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল গোলমাল। দেখতে দেখতে আরও কয়েকটা ছেলে এসে দাঁড়ালো সেখানে। দল হয়ে গেল দুটো। তর্ক শুরু হলো দুই দলে। অবস্থা দেখে মুসার মনে হলো, হাতাহাতিতেও গড়াতে পারে ব্যাপারটা।
মেয়েটার নাম মিস লিয়ারি গুন, ডেজার বললেন। প্রায়ই আসে সৈকতে। এলেই একটা না একটা গোলমাল বাধায়।
খাইছে! এই রকম কাণ্ড হয় এখানে! হরহামেশাই যদি এই অবস্থা হয়, প্যারেডের সময় না জানি কি ঘটে! নাহ, প্যারেডটা না দেখলেই নয়। আবা, কাল অবশ্যই আসবো।
আমিও আসবো, ঘোষণা করলো কিশোর পাশা।
.
০২.
পরদিন সকালে সৈকতের কাছে পৌঁছতেই তীক্ষ্ণ একটা শব্দ কানে এলো।