জবাব দিতে পারলো না কিশোর। বসে পড়লো বারান্দায়।
একটু পর ফিরে এলো মুসা। বললো, ডিগারের পিছু নিয়েছিলাম। কুকুরের। রহস্য জেনেছি। মুক্তিপণ দাবি করে না সে, পুরস্কার আদায় করে। দেখলাম, একটা সান্তা মনিকার কপি কিনলো। শুধু বিজ্ঞাপনগুলো দেখে ফেলে দিলো কাগজটা। সুযোগ করে ওটাও দেখলাম। একটা বিজ্ঞাপনের ওপর পেন্সিল দিয়ে দাগ দেয়া। সাদা-কালো একটা স্প্যানিয়েল কুকুরের জন্যে একশো ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা। হয়েছে। কিছুদিন আগে হারিয়ে গেছে কুকুরটা। কাগজটা ফেলে দিয়ে বাড়ির পেছন। থেকে একটা সাদা-কালো স্যানিয়েল বের করে আনলো ডিগার, নিয়ে গেল ওশন পার্কের একটা বাড়িতে। বেল টিপতে দরজা খুলে দিলো এক মহিলা। তাকে দেখে। দৌড়ে গিয়ে গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো কুকুরটা, চেটেচুটে অস্থির করে দিলো। ডিগারকে কিছু টাকা এনে দিলো মহিলা। প্রায় নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরলো ডিগার।
থেমে দম নিলো মুসা। তারপর বললো, কিন্তু এর সঙ্গে কিটুর নিখোঁজের সম্পর্ক কি বুঝতে পারছি না। ডবকে নিশ্চয় আটকাতে চায়নি ডিগার, ওই কুত্তা আটকে কোনো লাভ হতো না।
জবাব দিলো না কিশোর। ঘন ঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। গভীর চিন্তায়। ডুবে গেছে। হঠাৎ মুখ তুললো। হতে পারে, অন্য দিকে সরে যাচ্ছি আমরা। হয়তো কিটুর হারানোর সঙ্গে ক্যাম্পারের কোনো হাতও নেই। ডিগার হয়তো এতে জড়িত নয়। ছেলেটা ভীষণ দুষ্ট, হয়তো নিজে নিজেই গিয়ে কোথাও আটকা পড়েছে।
সরাইখানাটা দেখিয়ে বললো সে, কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে মাটির তলার ঘরে ঢুকে যেতে পারে। খোলা জানালা দিয়ে গিয়ে সেলারে ঢুকে বসে থাকতে পারে। পুলিশ অবশ্য খোঁজ করেছে, কিন্তু ওরা কি সমস্ত জায়গা তন্ন তন্ন করে। খুঁজতে পেরেছে? হোটেলটা ছাড়াও এখানে অসংখ্য জায়গা আছে, যেখানে একটা বাচ্চা ছেলে আটকা পড়তে পারে।
সোজা হয়ে বসলো রবিন। কি করতে বলো?
গ্যালারিতে রয়েছে এখন ক্যাম্পার। মারমেড ইনে খুঁজতে ঢুকবো আমরা। দেখি ক্যাম্পার কি বলে।
.
১৩.
পুরানো সরাইখানাটা খুলতে প্রথমে রাজি হতে চাইলো না ক্যাম্পার। অনেক বছর। ধরে তালা দেয়া রয়েছে। জানালা আটকানো। ছেলেটার ঢোকার পথ নেই।
কিটুর বয়সে, একটা গল্প শোনালো মুসা, একটা নির্জন বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলাম আমি। জানালা দরজা বন্ধ ছিলো, কিন্তু আমার ঢোকা তো বন্ধ করতে পারেনি। চিলে কোঠার জানালাটা ছিলো খোলা। গাছ বেয়ে উঠে ওই পথে ঢুকে পড়লাম। ঢুকেছি তো সহজেই, কিন্তু বেরোতে গিয়ে জান বেরিয়ে গেছে। অনেক কষ্টে তবে বেরিয়েছি।
মারমেড ইনের দিকে তাকিয়ে রইলো ক্যাম্পার। একতলা আর দোতলার জানালা বন্ধ, কিন্তু তিনতলার কিছু কিছু ভোলা। অসম্ভব! ওপথে ঢুকতে পারবে না কিটু। ঢুকতে হলে এই গ্যালারি কিংবা মিস্টার ডেজারের ছাতের ওপর দিয়ে গিয়ে উঠতে হবে। = আমরা বলছি না যে কিটুও ওরকম করেছে, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। কলছি, বাচ্চারা এমন অনেক কাজ করে বসে, বয়স্করা যা কল্পনাও করতে পারে না। খুঁজলে কি কোনো অসুবিধা হবে? হয়তো আটকা পড়ে আছে কোথাও, বেরোতে পারছে না। হয়তো জখম হয়েছে, কিংবা বেহুশ হয়ে আছে।
আর কিছু বলার থাকলো না ক্যাম্পারের। একগোছা চাবি বের করে CLOSED লেখা একটা দরজার দিকে এগোলো। সরাইতে কিটু আটকা পড়লে ডব বেরোলো কিভাবে?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
দেখতে চাইছো, দেখাচ্ছি। তবে অযথা সময় নষ্ট করছে।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ওরা, মারমেড ইনের মস্ত দরজার কাছে। দরজার তালা খুলে ঠেলে পাল্লা খুললো ক্যাম্পার। ছোট একটা হলওয়ে দেখা গেল, আবছা অন্ধকার আর প্রচুর ধুলো। হলওয়ে পেরিয়ে লবি, সেখানে বেশ কিছু সোফা আর চেয়ার অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। পুরু হয়ে ধুলো জমে থাকা জানালার কাঁচের। ভেতর দিয়ে আলো ঠিকমতো আসতে পারছে না। পচে টুকরো টুকরো হয়ে আছে কার্পেট। ফুলের টবে মরা গাছের শুকনো উঁটি খাড়া হয়ে রয়েছে এখনো। মেঝের ধুলোয় জুতোর ছাপ, পুলিশ এসে খোঁজাখুঁজি করে গেছে সেই চিহ্ন।
লবি বেরিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকলো ওরা। টেবিলের ওপরে স্তূপ করে রাখা। হয়েছে চেয়ার। ডাইনিং রুমের পরে অনেক গলিপথ, অফিস রান্নাঘর, স্টোররুম। সব জায়গায়ই খোঁজা হলো, কিন্তু কিটুকে পাওয়া গেল না।
রান্নাঘরে মাকড়সার রাজত্ব, জালের অভাব নেই। তাক আর আলমারি গুলোতে বাসা বেঁধেছে নেংটি ইঁদুর। এখানে সেখানে উঁকি দিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা, হঠাৎ পায়ের নিচে কোনোখান থেকে একটা অদ্ভুত গোঙানি কানে এলো।
ঝট করে সেদিকে তাকালো কিশোর ও মুসা।
কে! কে! বলে চিৎকার করে উঠলো মুসা।
এমনকি ক্যাম্পারের মুখও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। রান্নাঘরের একধারের একটা দরজা খুললো গিয়ে। তার কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিলো কিশোর। অন্ধকার একটা সিঁড়ি চোখে পড়ছে। কেমন যেন ভেজা ভেজা আর টক গন্ধ বাতাসে।
সেলার, ক্যাস্পার কললো। ওটা আগেও ব্যবহার হতো না খুব একটা। আর এখন তো প্রশ্নই ওঠে না। জোয়ার বেশি হলে পানি ঢুকে যায় ওখানে।
ডাইনিংরুম থেকে গিয়ে খুঁজে পেতে মোমবাতি বের করে আনলো রবিন। আস্ত নয়, মোমের একটা গোড়া।
মোম জ্বেলে আগে আগে চললো ক্যাম্পার, পেছনে তিন গোয়েন্দা।
সিঁড়ি বেয়ে নামছে ওরা, এই সময় আবার শোনা গেল গোঙানি। এবার আরও কাছে, আরও ভয়াবহ। পাথর হয়ে গেল যেন ওরা। হাত তুলে দেখালো মুসা, সেলারের ওপর দিকে দেয়ালে একটা জানালা। ম্লান একফালি আলো এসে ঢুকছে সে পথে। যানবাহনের আওয়াজও আসছে সেদিক দিয়ে। ধাতব একটা খটাখট, ঘটাং ঘটাং, তারপর আবার সেই ভয়ানক গোঙানি।