আবার সোজা হয়ে রাস্তা পেরিয়ে এলো রবিন। লুকিয়ে থেকে চোখ রাখার। জন্যে একটা সুবিধেমতো জায়গা খুঁজছে। একটা উঁচু বারান্দায় খেলছে দুটো ছেলে। ওটার সিঁড়িতে এসে বসলো সে। যেন ওদেরই একজন।
বসে আছে তো আছেই। অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে কি যে হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে একেবারে শূন্য, নির্জন। জানালার ভারি পর্দাগুলোর কোনোটাই সরা তো দূরের কথা, সামান্য কাঁপছেও না।
মিনিটের পর মিনিট কাটছে।
পনেরো মিনিট পর একটা গাড়ি বেরিয়ে এলো বাড়িটার পাশ থেকে। নীল বুইক। তীক্ষ্ণ হলো রবিনের দৃষ্টি। চেনা চেনা লাগছে গাড়িটা। ড্রাইভিং সীটে বসা আরোহীকেও চেনা লাগছে।
ঠিক! স্লেভ মার্কেটে দেখেছিলো আগের দিন! এই লোকটাই ডিগারের রুমমেটকে ট্রাকসহ ভাড়া করেছিলো। সেই একই টুপি মাথায়। চোখে কালো চশমা। পুরু গোফ।
রাস্তায় উঠে পুব দিকে মোড় নিলো গাড়িটা। গতি বাড়িয়ে চলে গেল।
নোটবুক বের করে নম্বর প্লেটের নম্বর আর বাড়িটার নম্বর লিখে ফেললো রবিন। নোটবুক বন্ধ করে ভাবতে লাগলো-বুইকের ওই আরোহীর সঙ্গেই দেখা করতে। এসেছে নাকি ক্যাম্পার? লোকটার সঙ্গে ডিগারের কোনো রকম যোগাযোগ আছে? নাকি যোগাযোগটা ডিগারের রুমমেটের সঙ্গে। স্লেভ মার্কেটে রুমমেটকে ভাড়া করার ব্যাপারটা কি শুধুই কাকতালীয় ঘটনা?
এভাবে এখানে বসে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। ক্যাম্পার বেরিয়ে তাকে দেখলেই বুঝে যাবে, নজর রাখছে রবিন।
উঠে অন্য কোথাও সরে যাওয়ার জন্যে জায়গা খুঁজলো সে। পেলো না। পায়ে। পায়ে আবার এগিয়ে গেল অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটার কাছে। কেমন যেন রহস্যময় লাগছে। কোনো নড়া নেই চড়া নেই শব্দ নেই। যেন ভূতের বাড়ি, মানুষ বাস করে না এখানে।
কয়েকবার দ্বিধা করে শেষে বাড়িটার আরও কাছে চলে এলো রবিন। দরজার বেল বাজালো। কেউ এলো না।
আরকটা দরজার আরেকটা বেল বাজলো। জবাব নেই। তৃতীয় আরেকটা বাজিয়েও সাড়া পাওয়া গেল না।
একটা জানালার কাছে এসে নাক চেপে ধরলো কাঁচের গায়ে। কাঠের মেঝে চোখে পড়লো। নির্জন। ধুলোয় ঢাকা। কয়েকটা খালি বাক্স পড়ে রয়েছে। বাড়িতে কেউ আছে বলে মনে হয় না। আলো জ্বলছে না। নিশ্চয় বিদ্যুৎ নেই। আর সে কারণেই হয়তো বেলের সুইচ টিপেও লাভ হয়নি, ঘণ্টা বাজেনি।
কিন্তু ক্যাম্পার গেল কোথায়?
সদর দরজা দিয়েই তো ঢুকেছিল..
হঠাৎ দম বন্ধ করে ফেললো রবিন। বুঝে ফেলেছে! সদর দরজা দিয়ে ঢুকেছে বটে, কিন্তু বাড়ির ভেতরে নেই ক্যাম্পার, বেরিয়ে গেছে পেছনের কোন দরজা দিয়ে। তারপর গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেছে। নীল বুইক! আলগা গোঁফ লাগিয়ে নিয়েছে। মাথায় নাবিকের টুপি। চোখে কালো চশমা।
পেছনে ভারি বুটের শব্দ হলো। ঝট করে ফিরে তাকালো সে। চমকে গেল।
বিশালদেহী একজন মানুষ। মাঝবয়েসী। টাকা মাথা। খপ করে রবিনের হাত চেপে ধরে বললো, এই ছেলে, এখানে কি?
শুকনো গলায় জানালো রবিন, ইস্কুলের ম্যাগাজিনের জন্যে রিসার্চ করছি, তথ্য সংগ্রহ করছি। নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনালো কথাটা।
লোকটাও বিশ্বাস করলো না। ধমক দিয়ে বললো, মিছে কথা বলার আর জায়গা পাওনি! ওই সিঁড়িতে বসে বসে চোখ রাখছিলে, দেখেছি আমি। তারপর উঠে এসেছে চুপি চুপি। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েছে। নিশ্চয় চুরির মতলব?
না না, আপনি ভুল করছেন! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। আমি চোর নই! লোকের সঙ্গে কথা বলতেই এসেছি। বেলপুশ টিপলাম। কেউ এলো না।
হাতের চাপ সামান্য ঢিল হলো।
এই সুযোগে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় দিলো রবিন।
এই থামো! থামো বলছি! চিৎকার শুরু করলো লোকটা। নইলে ভালো হবে না…
রবিন কি আর দাঁড়ায়? ঝেড়ে দৌড়াতে লাগলো।
.
১২.
মুসার মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে হাঙর।
হুমকির ভঙ্গিতে নামলো একবার। সঙ্গে করে ছুরি আনা উচিত ছিলো, আফসোস করলো মুসা। যখন ভাবলো, এইবার হামলা চালাবে, ঠিক তখনই হঠাৎ নাক উঁচু করে উঠে গেল ওটা। কয়েক ফুট উঠে দ্রুতগতিতে চলে গেল গভীর পানির দিকে।
যাক, বাঁচা গেল। আবার দম নিতে আরম্ভ করলো মুসা।
শক্ত কি যেন ধরে রয়েছে, মনে পড়লো এখন। পাথর নয় জিনিসটা। শক্ত, গোল, পিচ্ছিল কি যেন। ঘোলাটে পানিতেও চিনতে অসুবিধে হলো না তার। একটা জলকন্যার মাথা। চীনামাটির তৈরি। নিশ্চয় ব্রড় ক্যাম্পারের হারানো জলকন্যা! টুকরো টুকরো হয়ে সাগরের তলায় ছড়িয়ে রয়েছে মূর্তিটার অন্যান্য অংশ। এখনো কোনো কোনোটাতে জড়িয়ে রয়েছে ছেঁড়া বাদামী কাগজ।
এই তাহলে ব্যাপার! মূর্তিটাকেই এনে পানিতে ফেলে গেছে ক্যাম্পার! কিন্তু। কেন?
কয়েকটা টুকরো তুলে নিয়ে যাবে কিনা ভাবছে সে, এই সময় চোখের কোণে আবার দেখলো নড়াচড়া। কি ওটা, ভালো করে দেখার জন্যে থামলো না। প্রয়োজনও মনে করলো না। তার দৃঢ় বিশ্বাস, হাঙরটাই ফিরে এসেছে।
তীরের দিকে পাগলের মতো সাঁতরে চললো সে। অল্প পানিতে পৌঁছে উঠে দাঁড়ালো। দৌড়ানোর চেষ্টা করলো। ঝুপঝুপ, থপথপ, নানা রকম শব্দ করতে করতে কোনোমতে এসে উঠলে কিনারে। ধপ করে বসে পড়লো বালিতে। তারপর একেবারে চিৎপাত।
কি হয়েছে? কানের কাছে বেজে উঠলো হ্যাঁনসনের কণ্ঠ।
হাঙর! মাস্ক খুলে ফেলেছে মুসা, হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিলো।