এই থাম! চেঁচিয়ে চলেছে ডিগার, এই থাম…
অবশেষে কব্জির প্যাঁচ খুলে গেল। গড়িয়ে গিয়ে একটা ল্যাম্প পোস্টে বাড়ি লেগে থেমে গেল ডিগারের দেহটা।
বড় বড় কয়েক লাফে পার্কিং লট পেরিয়ে গিয়ে মনিবের ওপর প্রায় আঁপিয়ে পড়লো কুকুরটা। তার হাত চাটতে শুরু করলো।
কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো ডিগার। সারা গায়ে ধুলো আর মাটি। কাপড় ছিঁড়েছে। কয়েক জায়গায় ছড়ে গেছে চামড়া। শাই করে রাস্তার মোড় ঘুরে তার পাশে এসে ঘ্যাচ করে ব্রেক কষলো একটা পেট্রোল কার। লাফ দিয়ে নেমে এলো একজন পুলিশ অফিসার। এই, কি হয়েছে তোমার? ব্যথা পেয়েছো?
দৌড় দিলো ডিগার। পার্কিং লট থেকে চলে গেল পানির ধারে। একটা মুহূর্ত দ্বিধা করলো না। ঝাঁপ দিয়ে পড়লো পানিতে। অফিসারকে বোকা বানিয়ে সাঁতরে চললো খোলা সাগরের দিকে।
কুকুরের মনিবের পাশ দিয়ে বারান্দা থেকে নেমে এলো মুসা। কিশোরের দিকে এগোলো। একটা মার্সিডিজের গায়ে হেলান দিয়ে হো হো করে হাসছে গোয়েন্দা প্রধান। হাসতে হাসতে পানি বেরিয়ে গেছে চোখ দিয়ে। তার হাসিটা সংক্রমিত হলো মুসার মধ্যে। বললো, দারুণ একটা খেল দেখালো! একেবারে পানিতে ফেলে ছেড়েছে। কদ্দিন পর গোসল করলো কে জানে!
হাসি কমে এলো অবশেষে কিশোরের। জোরে জোরে দম নিয়ে বললো, এসো, যাই। রবিন কি করছে দেখিগে। বলেই আবার হা হা করে হেসে উঠলো।
.
০৮.
পার্কিং লটে একটা গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে রবিন। খোলা জানালা দিয়ে কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, কিন্তু কথা বোঝা যাচ্ছে না। আরেকটু এগিয়ে যাবে? বাড়ির সামনের সিঁড়িতে গিয়ে বসবে? নাকি পেছনের বেড়ার ভেতরে চলে যাবে?
ঠিক এই সময় একসঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো কুকুরগুলো। নাহ্, ভেতরে ঢোকা অসম্ভব। কিছু একটা দেখে চিৎকার করছে ওগুলো।
সামান্য সরতেই ট্রাকটা, চোখে পড়লো রবিনের। বাড়ির পাশের ড্রাইভওয়েতে পার্ক করা, বেড়ার বাইরে, একটা খোলা জায়গার ঠিক নিচে।
ট্রাকের পেছনে বস্তা আর বিছানার পুরানো গদি ফেলে রাখা হয়েছে কয়েকটা। নিশ্চয় কাঁচের জিনিসপত্র বহন করে ট্রাকটা। গদি আর বস্তার ওপর সাজিয়ে রাখা হয় যাতে না ভাঙে। নোঙরা, ময়লা গদিগুলো। কিন্তু দ্বিধা করার সময় নেই। একছুটে চলে এলো ট্রাকের পেছনে। উঠে পড়লো। লুকিয়ে পড়লো একটা গদির তলায়।
হ্যাঁ, বাড়ির ভেতরের লোকটার কথা এখন পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে রবিন। লোকটা উন্মাদ। কি যে করে বসবে ঠিক নেই। সর্বনাশ হয়ে যাবে তখন। সে। জন্যেই আরেকটা জায়গা খুঁজছি। এরই মধ্যে দুবার ঘুরে গেছে পুলিশ। জেনে যাবেই।
একটু বিরতি দিয়ে অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললো লোকটা, বড় ব্যাপার নয় মানে! অনেক বড় ব্যাপার! রাবিশ বিনে ফেলে রাখা কুত্তাটার কথা শোনোনি?
শক্ত হয়ে গেল রবিন। ডবের কথা বলছে।
আরে ঠিকই আছি আমি, ঠিকই আছি, বলে যাচ্ছে লোকটা। পাগল হইনি। যা-ই বলো, আমি থাকছি না। এখন যাচ্ছি, কিছু টাকা জোগাড় করতে পারি কিনা, দেখি। দরকার আছে।
আবার নীরবতা। তারপর লোকটা বললো, ঠিক আছে। যা হয় হবে। স্লেভ মার্কেট তো আছেই।
অবাক হলো রবিন। স্লেভ মার্কেট?
রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হলো। শুয়েই আছে রবিন। দরজা লাগানোর আওয়াজ হলো। তারপর বারান্দায় পদশব্দ।
শঙ্কিত হলো রবিন। লোকটা পেছনে আসবে না তো? না, এলো না। ট্রাকের দরজা খুলে উঠে বসলো একজন। গর্জে উঠলো ইঞ্জিন। ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করলো ট্রাক। ড্রাইভওয়ে থেকে রাস্তায় এসে উঠলো, বোঝা গেল।
অস্থির ভাবনা চলেছে রবিনের মাথায়। একবার ভাবলো লাফিয়ে পড়ে। পরে ভাবলো, দেখাই যাক না কোথায় যায়? লোকটা কে? ডিগারের রুমমেট? বিপদের আশঙ্কা করছে লোকটা, টেলিফোনে তার আলাপ থেকেই বোঝা গেছে। কার কাছ থেকে বিপদ? ডিগার? কিটুর ব্যাপারে কি কিছু জানে? তার আচরণ নিঃসন্দেহে সন্দেহজনক।
নিশ্চয় এখন রহস্যময় স্লেভ মার্কেটে চলেছে লোকটা। হয়তো ওখানে কিটুর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সূত্র পাওয়া যাবে।
ট্রাক চলেছে। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে মুখ বের করে দেখছে রবিন। শহরের রাস্তা, দোকান-পাট চোখে পড়ছে। সব অপরিচিত।
অবশেষে থামলো ট্রাক। ইজ্ঞিন বন্ধ হলো। ড্রাইভার বেরিয়ে যাওয়ার সময় মচমচ শব্দ উঠলো ট্রাকের সামনের অংশে।
লোকটা কি পেছনে আসবে? লাফিয়ে উঠে ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে পড়ার জন্যে তৈরি হলো রবিন।
কিন্তু এবারেও পেছনে এলো না লোকটা। তার পদশব্দ সরে যেতে লাগলো। যানবাহনের আওয়াজ কানে আসছে। বেশ ভিড়। আস্তে মাথা তুলে ট্রাকের পাশ দিয়ে উঁকি দিলো রবিন। চওড়া একটা জায়গার মধ্যে দিয়ে অনবরত আসছে যাচ্ছে। নানারকম গাড়ি। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি দোকানপাট। পথের পাশে এক জায়গায় জটলা করছে কিছু লোক। প্রায় সবাই বিশাল দেহী, পরনে কাজের পোশাক। কারো কারো পায়ে ভারি বুট, কারো মাথায় শক্ত হ্যাট। কালো চামড়ার লোক আছে, বাদামী চামড়ার আছে, বিভিন্ন দেশের মানুষ ওরা।
পথের মোড়ে একটা গাড়ি এসে থামলো। দ্রুত কয়েকজন লোক গিয়ে। ড্রাইভারকে ঘিরে দাঁড়ালো, কথা শুরু করে দিলো একসঙ্গে। এই সুযোগে টুক করে নেমে পড়লো রবিন। সরে গেল ট্রাকের কাছ থেকে।
শখানেক গজ দূরে একটা নিচু দেয়াল দেখে তার ওপর উঠে বসলো। কৌতূহলী চোখে দেখতে লাগলো লোকগুলোকে।