নানারকম জানোয়ার আর পাখি দেখতে দেখতে চলেছে ওরা। শটাশট ক্যামেরার শাটার টিপছে মুসা, যা দেখছে তারই ছবি তুলছে। কিশোরও তুলছে, তবে বেছে বেছে।
বন থেকে বেরিয়ে, উপত্যকা পেরিয়ে পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছলো ল্যাণ্ডরোভার। পাহাড়ী পথ বেয়ে উঠে এলো ওপরে, পোচারস লুকআউটে। টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে যন্ত্রটার মতোই স্থির হয়ে আছে একজন রেঞ্জার। টমসন ডাকতে ফিরে চেয়ে স্যালুট করলো।
কিছু দেখা যাচ্ছে? জিজ্ঞেস করলেন ওয়ারডেন।
তেমন কিছু না। শুধু শকুন।
টেলিস্কোপে চোখ রেখে দেখলেন টমসন। সরে জায়গা করে দিলেন, ছেলেদের জন্যে। ওরাও একে একে দেখলো। বনের কিনারে আকাশে চক্কর মারছে কয়েকটা শকুন। মরা দেখতে পেলে যেমন করে।
পোচার আছে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।
মনে হয় না। আমাদের লজ থেকে জায়গাটা মাত্র দুমাইল। এতো কাছে আসার সাহস করবে না ব্যাটারা। তবু চলো, গিয়ে দেখি।
গাড়ি চলে গেল ওখানে। ছোট ছোট কয়েকটা গাছের গোড়ায় পড়ে আছে বিরাট একটা দেহ। ধারেকাছে পোচারদের ছায়াও নেই। ওরা গাড়ি থেকে নেমে এগোতেই ডানা জাপটে উড়ে গেল কয়েকটা শকুন।
গণ্ডার, বললেন টমসন।
মৃত জানোয়ারটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা। পেটে পিপার মুখের সমান বড় এক ফোকর। ভেতরে নাড়িভুড়ি কিছু নেই, সব সাফ করে খেয়ে ফেলেছে। দুর্গন্ধে পাক দিয়ে ওঠে পেটের ভেতর। সইতে না পেরে নাকে রুমাল চাপা দিলো মুসা। রবিন তো ওয়াক থু করে বমিই করতে বসে গেল।
উঁকি দিয়ে গর্তের ভেতরে দেখলো কিশোর। বিড় বিড় করলো, বেচারা! কি করে মরলো? অসুখে?
তাই হবে হয়তো, মুসা বললো।
তীক্ষ দৃষ্টিতে গণ্ডারটার মাথার দিকে তাকিয়ে আছেন টমসন। ভুল করেছি আমি, বললেন তিনি। ভেবেছিলাম, পোচাররা এতো কাছে আসার সাহস পাবে না, ভুল বলেছি। দেখো, শিং নেই। কেটে নিয়ে গেছে। গণ্ডারের শিং খায় না। কোনো জানোয়ার। তার মানে পোচাররা নিয়ে গেছে। ওরাই মেরেছে এটাকে, গলার কাছে একটা ক্ষত দেখালেন। দেখো, বল্লম দিয়ে মেরেছে।
ইস, পিশাচ নাকি ওরা! গণ্ডারটার ক্ষতবিক্ষত লাশের দিকে তাকাতে পারছে না রবিন।
এটা আর এমন কি? ওদের নিষ্ঠুরতা তো দেখোইনি। চলো, দেখাবো।
কয়েক মিনিট গাড়ি চালিয়ে একটা জায়গায় এসে থামলেন টমসন। এই যে, টিসাভো নদী।
কোনো নদী চোখে পড়লো না ছেলেদের। শুধু কালো রুক্ষ একটা ছোট পাহাড়।
কই, নদী কোথায়? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
নদীর ওপর দিয়ে হেঁটেছে কখনও? মুসার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন ওয়ারডেন, হাসছেন মিটিমিটি। না হাঁটলে এটাই সুযোগ। হেঁটে নাও।
কালো পাথরে উপত্যকার ওপর দিয়ে ছেলেদের নিয়ে চললেন তিনি। একখানে থেমে জোরে লাথি দিলেন মাটিতে। ফাপা আওয়াজ হলো।
লাভার স্তর মনে হচ্ছে? কিশোর বললো।
লাভ-ই। আদিমকালে কোনো সময় কিলিমানজারো থেকে নেমে এসে ঢেকে দিয়েছে নদীটা। আমাদের পায়ের নিচেই বইছে ওটা। ভাটির দিকে যাচ্ছি আমরা।
যতোই এগোচ্ছে, কানে আসছে একটা ঝিরঝির শব্দ। বাড়ছে শব্দটা। শেষে, একটা টিলা ঘুরে এসে দেখতে পেলো, টিলার গোড়ার বিশাল ফোকর থেকে সগর্জনে ছিটকে বেরোচ্ছে তীব্রস্রোতা পাহাড়ী নদীর পানি। অতিকায় এক ড্রেনের মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে যেন। নিচে যেখানে পড়ছে, বড় একটা দীঘি তৈরি করেছে। সেখানে, কিংবা বলা যায় ছোট হ্রদ। হ্রদ থেকে বেরিয়ে উপত্যকা ধরে একেবেকে বয়ে গেছে সরু নদী।
এর নাম মিজিমা স্প্রিং। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ থাকে পানি, ওয়ারডেন বললেন।
কিন্তু এখন পানি পরিষ্কার নয়। লালচে বাদামী, দুর্গন্ধ হয়ে আছে।
এতোক্ষণ নদীর ওপর দিয়ে এসেছো, বললেন তিনি। এবার তলায় নিয়ে যাবো।
ছেলেদের নিয়ে একটা ঝোপের ভেতরে ঢুকলেন টমসন। মাটিতে একটা গর্ত দেখা গেল। ওটা দিয়ে ঢুকে, ঢালু সুড়ঙ্গ বেয়ে একটা প্রাকৃতিক গুহায় এসে ঢুকলো। ওরা। গুহাটাকে কেটে ঘরের মতো বানিয়ে নেয়া হয়েছে। আণ্ডারওয়াটার। অভজারভেটরি, নদীর তলার দৃশ্য দেখার জন্যে। জানালার ভেতর দিয়ে নদীর। নিচটা দেখা গেল পরিষ্কার। পানির ওপরে রোদ ঝলমল করছে, নিচেও আসছে। আলো।
জানালার কাছে নাক ঠেকালো তিন গোয়েন্দা। বাইরের দৃশ্য দেখে গা গুলিয়ে। উঠলো। অসংখ্য জলহস্তী, নদীর তলায় চরে বেড়াচ্ছে না আর ওগুলো, জলজ ঘাস ছিঁড়ে খাচ্ছে না, মরে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। মরা লাশের স্তূপ, কোনো কোনোটা বেশি ফুলে গিয়ে ভেসে উঠেছে ওপরে। মারাত্মক ক্ষতগুলো থেকে এখনও রক্ত চুঁইয়ে বেরিয়ে মিশে যাচ্ছে পানির সঙ্গে। লেজ কাটা। জায়গায় জায়গায় চামড়া ছিলে নেয়া হয়েছে। বড় বড় শ্বদন্তগুলো সব উপড়ে তুলে নিয়ে গেছে পোচাররা। কিছু জানোয়ারের মাথা কেটে নিয়ে গেছে, বিশেষ করে মাদীগুলোর।
কয়েকটা শিশু জলহস্তী এখনও জীবিত, ক্ষুধায় কাহিল হয়ে বার বার গিয়ে নাক ঘষছে মৃত মায়ের গায়ে। অবোধ শিশুগুলো বুঝতে পারছে না, আর কোনোদিন জাগবে না মা, আদর করে গা চেটে দিয়ে দুধ খাওয়াবে না।
বড় বড় কুমির দল বেঁধে এসে মহানন্দে জলহস্তীর মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে। বুড়ো মাংসে অরুচি ধরে যাওয়াতেই বোধহয় কোনো কোনোটা মরা হাতি বাদ দিয়ে শিশু হাতির নধর কচি মাংস দিয়ে নাস্তা সারছে। বিরাট হাঁ একেকটার, আর ইয়া বড় বড় দাঁত। দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। মাঝে মাঝে লড়াই লেগে যাচ্ছে পছন্দসই মাংসের মালিকানা নিয়ে, শক্তিশালী লেজের জোরালো ঝাপটায় আলোড়িত হচ্ছে পানি। শুধু কুমিরই না, শয়ে শয়ে মাংসাশী মাছও গপ গপ করে গিলছে জলহস্তীর মাংস।