তিরিশ ফুট দূরে আলাদা একটা কুঁড়েতে রান্নাঘর বানানো হয়েছে। একটা আফ্রিকান ছেলে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, খাবার লাগবে কিনা। হাসি এসে গেল মুসার।
খোলা জায়গায় বসে খাওয়া আর চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা চললো একই সঙ্গে। সবুজ উপত্যকার পরে লাল পাহাড়, দূরে নীলকিলিমানজারো পর্বতের উনিশ হাজার ফুট উঁচু তুষারে ঢাকা চূড়া।
উপত্যকা থেকে রোদ চলে গেছে। নামছে গোধূলির আবছা অন্ধকার। কিন্তু সূর্য যে একেবারে ডুবে যায়নি, কিলিমানজারোর চকচকে চূড়ার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সাদা তুষার এখন গাঢ় লাল। সূর্য যতোই দিগন্তের নিচে হারিয়ে যেতে লাগলো, ফ্যাকাসে হয়ে গেল লাল রঙ, শেষে আর কিছুই থাকলো না। ঝুপ করে হঠাৎ যেন নেমে এলো অন্ধকারের চাদর। আকাশে ফুটলো বড় বড় উজ্জ্বল তারা।
দূরে দূরে ছিলো এতোক্ষণ জন্তুজানোয়ারেরা,রাত নামতেই খাবারের গন্ধে আর পানির লোভে পায়ে পায়ে এসে হাজির হলো অনেকে।
বসে বসে কিছুক্ষণ দেখলো ছেলেরা। সারা দিন প্রচণ্ড পরিশ্রম গেছে। ঘুমে জড়িয়ে এলো চোখ। বসে থাকতে পারলো না আর। উঠে, শুতে চললো।
০৬.
ওদের মনে হলো, সবে শুয়েছে এই সময় দরজায় থাবা দিয়ে জাগিয়ে দেয়া। হয়েছে। চোখ মেলে দেখলো, বাইরে অন্ধকার কেটে গেছে। খোলা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভোরের ধূসর আকাশ।
দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন টমসন। সকালের পেট্রলে যেতে চাও? জানোয়ার দেখার এটাই সবচেয়ে ভালো সময়।
ওয়ারডেনকে দেখে অবাক হলো তিন গোয়েন্দা। অসামান্য ক্ষমতা তাঁর শরীরের। এতো বড় একটা ধকলের পর এতো তাড়াতাড়ি সামলে নিলেন!
আপনার হাত কেমন? ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হাতের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
ভালোই। এই যে, নাড়তে পারছি। কপাল ভালো, মাংসে গেঁথে ছিলো। তীরটা, হাড়-টাড়ে লাগেনি। কদিনেই ভালো হয়ে যাবে। ওঠো, উঠে কাপড় পরে নাও। আমি কফির কথা বলছি।
হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পরে বারান্দায় এসে দেখলো ওরা, টেবিলে বড় এক পাত্র কফি আর কয়েকটা কাপ সাজানো। বাইরে এখনও কুয়াশা। কিলিমানজারোর নিচের অংশটা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু রোদ পড়ে চকচক করছে চূড়া। কাঁচা রোদে এখন হয়ে গেছে সোনালি। ভাসছে যেন কুয়াশার ওপর। দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। তিন গোয়েন্দা।
মুসাকে ঘন ঘন রান্নাঘরের দিকে তাকাতে দেখে হেসে ফেললেন টমসন। এখানে অন্যরকম নিয়ম আমাদের। ভোর বেলা অলস হয়ে থাকে জানোয়ারের: দল, বেশির ভাগই বাইরে থাকে। টুরিস্টদেরকে তাই এই সময়ই দেখানোর জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়। শুধু কফি খেয়েই চলে যাই। নটার দিকে ফিরে এসে নাস্তা।
টুরিস্ট কই? রবিন জিজ্ঞেস করলো। আর কাউকে তো দেখছি না। ওই ব্যাণ্ডাগুলো সব খালি নাকি?
হ্যাঁ, জানালেন ওয়ারডেন। এখন টুরিস্ট সীজন নয়। তবে আগে এসময়ও কিছু কিছু আসতো। এখন সীজনের সময়ও আসে না, পোচারদের জ্বালায়। শয়তানগুলোকে দমাতে না পারলে কেনিয়া সরকারের একটা বড় ইনকাম নষ্ট হয়ে যাবে।
কফি খেয়ে এসে ওয়ারডেনের ল্যাণ্ড রোভারে উঠলো সবাই। আধ মাইল এগোতেই দেখা গেল, সামনে পথ রুদ্ধ। এক পাল মোষ দাঁড়িয়ে আছে। শখানেকের কম হবে না। বিশাল কালো শরীর, মস্ত শিং।
গাড়ি থামিয়ে দিলেন টমসন। ভেতর দিয়ে যাওয়া যাবে না।
দলের সব চেয়ে বড় মোষটা শিং বাগিয়ে তেড়ে এলো, থেমে গেল গাড়ির বিশ ফুট দূরে। ভয়ানক ভঙ্গিতে শিং নেড়ে হুমকি দিলো।
ব্যাটা দলের সর্দার, নিচু কণ্ঠে বললেন টসমন। বিপদ বুঝলেই হামলা চালাবে। চোখের পলকে সব কটা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের ওপর।
খাইছে! তাহলে? কুঁকড়ে গেল মুসা।
বসে থাকতে হবে আমাদের। ওরা চলে গেলে তারপর এগোবো।
মাটিতে পা ঠুকে কিছুক্ষণ ফোঁস ফোঁস করলো মোষটা। প্রতিপক্ষকে লড়াই ঘোষণা করতে না দেখে যেন নিরাশ হয়েই ফিরে চললল। কয়েক কদম গিয়ে ফিরে চেয়ে বিচিত্র একটা শব্দ করলো, যেন ভীতুর ডিম বলে ব্যঙ্গ করলো। তারপর গিয়ে ঢুকলো পালের মধ্যে। উত্তেজিত হয়ে সর্দারের হাবভাব লক্ষ্য করছিলো দলটা, ভাটা পড়লো উত্তেজনায়। কেউ মুখ নামিয়ে ঘাস ছিঁড়তে শুরু করলো, কেউ বা বাচ্চার পরিচর্যায় মন দিলো। কয়েক মিনিট ওভাবেই কাটানোর পর রওনা হলো দলটা। হারিয়ে গেল বনের ভেতরে।
আবার চললল ল্যাণ্ডরোভার। পোচারস লুকআউটে চলে যাবো, বললেন ওয়ারডেন।
খোলা জায়গা পেরিয়ে বনে এসে ঢুকলো গাড়ি। জঙ্গল এখানে পাতলা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গাছপালা। অ্যাকেইশাঁই বেশি। কাঁটা ঝোপঝাড় রয়েছে। অনেক। ওগুলোর ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে হাটবীস্ট, ওয়াটারবাক, জেরিনুক, আর হাই-জাম্প লং-জাম্প দুটোতেই ওস্তাদ সুন্দর ইমপালা হরিণ। ঘোৎ ঘোঁৎ করে পথের ওপর এসে পড়ছে বনের ভাড় নামে পরিচিত শুয়োর, ওয়ার্টহগ। গাড়ি দেখে চমকে উঠে হাস্যকর ভঙ্গিতে শরীর মাথা নাচিয়ে গিয়ে আবার ঢুকে পড়ছে। বড় একটা গাছের মাথায় বসে থাকতে দেখা গেল এক ঝাঁক বেবুনকে। গাড়িটা নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় কুকুরের মতো দাঁত ভেঙচে অনেকটা কুকুরের মতোই ঘেউ ঘেউ করে উঠলো।
এক জায়গায় দেখা গেল, গাছের ডাল-পাতা ভেঙে ভেঙে খাচ্ছে ডজনখানেক ছোট-বড় হাতি। একেবারে পাশ দিয়ে গেল গাড়িটা, ফিরেও তাকালো না ওরা। নিজের কাজে ব্যস্ত।