.
০৫.
নড়ে উঠলেন টমসন। দুই লাফে গিয়ে কিশোরকে সরিয়ে পাশে বসে পড়লেন জজ। ওয়ারডেনের হাত তুলে নাড়ি টিপে ধরলেন।
চোখ মেলতেই উদ্বিগ্ন, অশ্রুভেজা একটা প্রিয় মুখ দেখতে পেলেন টমসন। উষ্ণ আন্তরিক চাপ অনুভব করলেন হাতে। চুপ করে পড়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর কথা বললেন। দুর্বল কণ্ঠই বুঝিয়ে দিলো কতোখানি নরম হয়ে গেছে তার। শক্তিশালী শরীরটা। থ্যাঙ্ক ইউ.. তুমি যে কতো উপকার করলে আমার! ছেলেদের ওপর নজর পড়তে বললেন, পরিচয় হয়েছে?
না, বললেন জজ। তোমাকে নিয়েই তো কাটলো। সময় আর পেলাম কই?। পোচার।
তাহলে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে হাত মেলাও। ও কিশোর পাশা—মুসা আমান: রবিন মিলফোর্ড। ছেলেরা, এ হলো গিয়ে আমার প্রিয় বন্ধু জজ নির্মল। পাণ্ডা। এবার নিয়ে কয়েকবার প্রাণ বাঁচালো আমার। তুমি না থাকলে, নির্মল…
আরে রাখো তো ওসব কথা, বন্ধুকে থামিয়ে দিলেন জজ পাণ্ডা। মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, এমন কোনো কঠিন কাজ ছিলো না। অবশ্য জানা থাকলে সব। সহজই মনে হয়। একটা কোরামিন ইঞ্জেকশন, ব্যস।
অনেক কিছু জানে ও, ছেলেদের কাছে বন্ধুর প্রশংসা করলেন ওয়ারডেন। কিভাবে কি করেছে ভালোমতো দেখেছো তো? শিখে রাখলে কাজ দেবে।
হ্যাঁ, তা দেখেছি, জবাব দিলো কিশোর। খুব কাছে থেকেই দেখেছি, জিভের ডগায় এসে গিয়েছিলো, না দেখলে এতোক্ষণে মরে যেতেন আপনি, কিন্তু বললো না। তাড়াহুড়োয় ওরকম ভুল করতেই পারে লোকে, জজ সাহেব তো আর ডাক্তার নন। ডাক্তাররাও ভুল ওষুধ দিয়ে রোগী মেরে ফেলে অনেক সময়। তাছাড়া। মিস্টার টমসনকে খুন করে তার কি লাভ?
তবে, খুন করার ইচ্ছে থাকলে মস্ত একটা সুযোগ গেছে। ক্ষতের মধ্যে রয়েছে। অ্যাকো বিষ, রক্তে ছড়িয়ে পড়েছে। আরও খানিকটা ইনজেক্ট করে ঢুকিয়ে দিলে কেউ ধরতে পারতো না, এমনকি ময়না তদন্তেও ফারাকটা বোঝা যেতো না। দূর, কি আজেবাজে কথা ভাবছে! নিজেকে ধমক দিয়ে জোর করে ভাবনাটা মন থেকে সরিয়ে দিলো কিশোর। ওই তো বসে আছেন হাসিখুশি ছোট্ট মানুষটা, নিষ্পাপ চেহারা, বন্ধুর জন্যে জান কোরবান।
শুনে খুশি হবে, নির্যাল, ওয়ারডেনের গলার জোর কিছুটা বেড়েছে। ছেলেগুলোর সুনাম আছে আমেরিকায়। এই বয়েসেই তুখোড় গোয়েন্দা হয়ে। গেছে। এমনকি পুলিশের চীফ পর্যন্ত ওদেরকে সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছে। বেড়াতে এসেছে এখানে। খুব রেগেছে পোচারদের কথা শুনে। আমাদের সাহায্য করবে কথা দিয়েছে।
আচ্ছা! তাই নাকি? মিষ্টি করে হাসলেন জজ। খুব ভালো কথা। তবে ছেলেরা, সাবধান করে দিচ্ছি। এটা আমেরিকা নয়। আর হারানো আঙটি কিংবা বাচ্চার পুতুল খুঁজে দেয়ার ব্যাপারও নয়। এখানে একদল খুনীকে নিয়ে কারবার। এই তো, একটু আগেই তো দেখলে, ওয়ারডেনকেই শেষ করে দিচ্ছিলো।
নির্মল, এতো ছোট করে দেখোনা ওদের। অনেক অভিজ্ঞতা আছে, খুনে বদমাশও ধরেনি তা নয়। আমাজানের গভীর জঙ্গল থেকেও ঘুরে এসেছে ওরা, নরমুণ্ড শিকারীদের খপ্পর থেকে পালিয়ে এসেছে, ধরে নিয়ে এসেছে অনেক দুর্লভ, ভয়ঙ্কর জানোয়ার।
কিন্তু তবু, নরম গলায় প্রতিবাদ করলেন জজ। পোচারদের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না।
সেটা ঠিক। তবে আমরা নরম হয়ে আছি লোকবল নেই বলে। কাল থেকে বোধহয় আর থাকবে না।
কেন?
আরও জনা তিরিশেক রেঞ্জার আসছে।
কখন?
আশা করছি কাল দুপুরে।
হঠাৎ কি মনে পড়তে যেন চমকে উঠলেন জজ। হায় হায়, অনেক দেরি হয়ে গেছে। জরুরী কাজ আছে, ভুলেই গেছি। নাইরোবিতে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, পথেই যখন পড়লো দেখা করে যাই। মনে হয় তোমার ভাগ্যই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলো। যাকগে, উঠি, নইলে রাতের আগে পৌঁছতে পারবো না। ও, আসল। কথাটাই এখনও জানা হয়নি। তীরটা কোন জায়গায় খেলে?:
পশ্চিমে ক্যাম্প করেছে ব্যাটারা। এখান থেকে মাইল সাতেক হবে।
তাহলে তো কাছেই। লোকও যখন পাচ্ছো, আশা করি ধরে ফেলতে পারবে। তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, বয়েজ। আবার সাবধান করছি। মনে। রেখো, এটা আমেরিকার আধুনিক শহর নয়, বলে, আবার একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বেরিয়ে গেলেন জজ।
দিন একটা গেল বটে তোমাদের! জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন জজ। আমার জন্যে আর ভেবো না, ঠিক হয়ে যাবো। যাও, গিয়ে বিশ্রাম নাও। তিন নম্বর ব্যাণ্ডায় তোমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কিছু দরকার হলে যে-কোনো একজন রেঞ্জারকে ডেকে বলো। ওদেরকে নির্দেশ দেয়া আছে।
কেবিন থেকে বেরিয়ে দেখলো ওরা, একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। নিশ্চয় জজ নির্মল পাণ্ডার গাড়ি। ভুরু কুঁচকে তাকালো কিশোর। ওদিকে যাচ্ছে কেন? নাইরোবির সড়ক তো উত্তরে। ওটা যাচ্ছে পশ্চিম দিকে!
পড়ন্ত বেলার রোদ লাগছে চোখেমুখে। চোখ ছোট ছোট করে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা, যতোক্ষণ না ওটা ছায়াঢাকা বুনোপথে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে, গেল।
খাইছে! বলে উঠলো মুসা। ওদিকে গেল কেন? নাইরোবি তো ওদিকে গেল কেন? নাইরোবি তো ওদিকে নয়।
লোকটার আচরণ ভারি অদ্ভুত লেগেছে আমার, রবিন বললো।
কিশোর কিছু বললো না। ঘন ঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। পোচার
***
কেবিন, বা কটেজের আফ্রিকান নাম, ব্যাণ্ডা। তিন নম্বর ব্যাণ্ডায় বেশ বড় একটা লিভিংরুম আছে, বড় বড় চেয়ারে আরাম করে বসা যায়। ওপর দিকে তাকালেই চোখে পড়বে খড়ের চালায় অসংখ্য টিকটিকি, মাছি পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে, ধরে খেয়ে ফেলছে। পাশেই বেডরুম, তাতে তিনটে বিছানা পাতা। গোসলখানা আছে, ভাড়ার ঘর আছে। সব চেয়ে লোভনীয় মনে হলো ওদের কাছে, রেলিঙে ঘেরা বেশ ছড়ানো একটা বারান্দা। ডাইনিং টেবিল আছে ওখানে, আর কিছু ক্যাম্প চেয়ার বসে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। জন্তুজানোয়ার আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পারবে। যতো খুশি।