খারাপ হবে আরও, খোকা, ধৈর্য ধরে ছেলেকে বোঝাচ্ছেন যেন অভিজ্ঞ পিতা। ওসব বোয়ামোছা বাদ দিয়ে আগে ইনজেকশন দিতে হবে। বিষের প্রতিষেধক।
অ্যামোনিয়াম কারবোনেট?
সরু হয়ে গেল জজের চোখ। ওই কিশোর ছেলেটা এতো কিছু জানে দেখে। অবাক হয়েছেন, যেন, কিছুটা অস্বস্তিও ফুটলো বুঝি চোখের তারায়। পরক্ষণেই মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়লো মুখে, দূর হয়ে গেল অস্বস্তি। এইবার ঠিক বলেছো। দেখি, ডিসপেনসারিতে আছে কিনা।
ওঘর থেকে বেরিয়ে, বারান্দা দিয়ে গিয়ে আরেকটা ঘরে ঢুকলেন জজ। কৌতূহলী হয়ে তার পিছু নিলো কিশোর। সময় মতোই গিয়ে ঢুকলো ডিসপেনসারিতে। দেখলো, তাকের সামনের সারি থেকে একটা বোতল তুলে নিয়ে সবগুলো সারির পেছনে রেখে দিচ্ছেন তিনি, এমন জায়গায়, সহজে যাতে চোখে পড়ে। পায়ের শব্দে ফিরে তাকালেন। অ্যামোনিয়াম নেই। পেলে ভালো। হতো। নেই যখন, কি আর করা? কোরামিনই দিতে হবে। হার্ট স্টিমুল্যান্ট। হৃৎপিণ্ডটাকে চাঙ্গা করে তুলতে হবে এখন।
একমত হলো কিশোর। জজের ওপর ভক্তি ফিরে এলো আবার! কোরামিন। খুঁজতে সাহায্য করলো তাকে।
কিশোর! ও কিশোর! রবিনের ডাক শোনা গেল। জলদি এসো! নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে!
বেডরুমে ছুটে গেল কিশোর।
কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে ওয়ারডেনের চেহারা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দ্রুত গিয়ে তার মুখে মুখ লাগিয়ে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া হলো কিঞ্জ হাতে ঘরে ঢুকশোর। উরুতে দ্বির, কালচে বাদাগেই হঠাৎ চালাতে শুরু করলো সে।
চালিয়ে গেল, যতোক্ষণ না আপনাআপনি শ্বাস নিতে পারলেন টমসন। হৃৎপিণ্ডে উত্তেজক কিছু ঢোকাতে না পারলে থেমে যাবে আবার শিগগিরই। জজের হলো কি? সিরিঞ্জে কোরামিন ভরতে পারলেন না এখনও?
সিরিঞ্জ হাতে ঘরে ঢুকলেন জজ। টমসনের পাশে বসে সুচ লাগালেন ক্ষতে। ওখানে কে?–ভাবলো কিশোর। উরুতে দিলে ভালো হতো না? তারপর চোখ পড়লো সিরিঞ্জের ভেতরের তরল পাদর্থের ওপর, কালচে বাদামী।
আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেল কিশোর। সুচ ঢোকানোর আগেই হঠাৎ জজের কব্জি চেপে ধরলো। কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকালেন জজ।
মাপ করবেন, স্যার, হাত ধরে রেখেই বললো কিশোর।
বোধহয় ভুল হয়েছে আপনার। রঙটা দেখুন। কোরামিন নয়, বরং অ্যাকোকেনথেরার মতোই লাগছে।
সিরিঞ্জের দিকে তাকালো জজ, আঁতকে উঠলো। তাই তো! ঠিকই তো বলেছো। সর্বনাশ করে দিয়েছিলাম আরেকটু হলেই। পাশাপাশি দুটো বোতল ছিলো। তাড়াহুড়োয় কোরামিন ভরতে যেয়ে ভুলে আরেকটা ভরে ফেলেছি।
প্রায় জোর করে সিরিঞ্জটা জজের আঙুলের ফাঁক থেকে বের করে নিয়ে ডিসপেনসারিতে রওনা হলো কিশোর। লোকটার ডাক্তারি বিদ্যার ওপর ভরসা নেই আর তার, সন্দেহ জাগছে। তবে ডিসপেনসারিতে ঢুকে সন্দেহ দূর হয়ে গেল। মিথ্যে বলেননি জজ। মাঝের তাকে পাশাপাশি দুটো বোতল রাখা আছে, একটাতে লেবেল লাগানো রয়েছে কোরামিন, আরেকটাতে অ্যাকো। ওভাবে রাখাটা স্বাভাবিক। কারণ একটার পর পরই আরেকটা ব্যবহার হয়। রেঞ্জাররা যখন বড় কোনো জানোয়ার ধরে, চিকিৎসা করার জন্যে, ওটাকে বেহুশ করে নিতে হয়। আগে। হাতি-গণ্ডার-জিরাফ-সিংহ কোনোটাই সচেতন অবস্থায় চিকিৎসা নিতে রাজি নয়। খুব সামান্য পরিমাণ অ্যাকোনাইট ঢুকিয়ে দেয়া হয় জানোয়ারের রক্তে। ডাটের সাহায্যে। তাতে বেহুশ হয়ে যায় জীবটা। পরে কোরামিন দিয়ে ওটাকে আবার সুস্থ করে তোলা হয়।
জজের ওপর থেকে সন্দেহ চলে গেল কিশোরের। একজন ভদ্রলোককে সন্দেহ করেছিলো বলে লজ্জা লাগলো এখন। বিষ ভরা সিরিঞ্জটা ভেঙে ফেলে দিয়ে নতুন আরেকটা সিরিঞ্জ বের করে তাতে কোরামিন ভরে নিলো। ফিরে এসে জজকে অনুরোধ করলো, আমি পুশ করি, স্যার? পারবো, ফার্স্ট এইডের ট্রেনিং আছে আমার।
নীরবে মাথা কাত করলেন জজ। সরে জায়গা করে দিলেন।
টমসনের উরুতে ইনজেকশন দিলো কিশোর। তারপর নাড়ি ধরে বসে রইলো চুপ করে। শ্বাস আর বন্ধ হলো না তার। তবে নাড়ির গতিও বাড়ছে না, খুব ক্ষীণ। আধ ঘন্টা পর বাড়তে শুরু করলো। এতো দ্রুত, প্যালপিটেশন শুরু হয়ে গেল। ভালো লক্ষণ নয় এটা। ঘাবড়ে গেল সে। জজকে বললো সেকথা।
পায়চারি করতে করতে থমকে দাঁড়ালেন জজ। বললেন, ভয় নেই, ঠিক হয়ে। যাবে। ওরকমই হয়।
তা-ই হলো। ধীরে ধীরে কমে আবার স্বাভাবিক হয়ে এলো নাড়ির গতি।
সেকথা জানাতেই ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন জজ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন। উদ্বেগ চলে গেল চেহারা থেকে। বললেন, ওকে হারালে মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের। ওর মতো লোক এখন দরকার, বেচারা। জানোয়ারগুলোকে বাঁচানোর জন্যে। পোচাররা শেষ করে ফেলবে সব। ওদের জ্বালায় অস্থির হয়ে আছি…ও হ্যাঁ, জানো না বোধহয়, আফ্রিকান ওয়াইল্ড লাইফ সোসাইটির আমি একজন ডিরেক্টর। ব্যাটাদের ধরতে পারলে, দাঁত কিড়মিড় করলেন তিনি। আর যদি কোর্টে আমার সামনে পাই! এমন শাস্তি দেবো…কি যে কষ্ট দিয়ে মারে জানোয়ারগুলোকে, না দেখলে বুঝবে না! চোখের কোণে পানি টলমল করে উঠলো তার। তাকালেন ওয়ারডেনের দিকে। ও শুধু আমার বন্ধু না, ভাইয়ের মতো। ও না বাচলে… গলা ধরে এলো তার। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন।
কারও দুঃখ সইতে পারে না মুসা। তার চোখেও পানি এসে গেল। রবিন নীরব। শুধু কিশোরের কোনো ভাবান্তর নেই। চুপচাপ তাকিয়ে আছে জজের। দিকে। চিন্তিত।