যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া শুরু করলো সে। কয়েক মিনিটেই অনেকখানি বুঝে ফেললো, কোনটা কি কাজ করে। ক্যাম্পের ওপর চক্কর দিলো একবার। উড়ে গেল আবার মাঠের দিকে। মনে মনে আন্দাজ করে নিলো কোন জায়গাটায় নামালে গাছের গায়ে ধাক্কা লাগবে না।
প্লেনের নাক নিচু করে ল্যাণ্ডি করতে যাবে, এই সময় এয়ারস্ট্রিপের ঘাসের মধ্যে একটা নড়াচড়া চোখে পড়লো। হলুদ আর কালো রঙের কি যেন। নড়ে উঠলো আবার। কী, বোঝা গেল। সিংহের একটা পরিবার।
রোদ পোহাচ্ছে ওরা। প্লেনের আওয়াজে কর্ণপাত করছে না। মুসার জানা। আছে, প্লেন, রেলগাড়ি, মোটরগাড়ির আওয়াজকে ভয় করে না সিংহ, বিশেষ করে ন্যাশনাল পার্কের জানোয়ারগুলো। ওসব যানবাহন দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেছে ওদের।
সিংহগুলোর জন্যে প্লেন নামানো যাবে না, ল্যাণ্ডিঙের পথ জুড়ে রয়েছে ওগুলো। কখন যাবে না যাবে তারও ঠিক নেই। দেরিও করা যাচ্ছে না। টমসনের। অবস্থা খুব খারাপ। তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে হবে, তাড়াতে হবে। সিংহগুলোকে।
প্রায় ডাইভ দিয়ে ওগুলোর বিশ ফুটের মধ্যে চলে এলো বিমান নিয়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরাম করে শুয়ে-বসে আছে ওরা ঘাসের মধ্যে। অল্প বয়েসীগুলো অলস চোখে তাকালো প্লেনের দিকে, বয়স্কগুলো চোখই মেললো না। কালো কেশরওয়ালা বিশাল এক পশুরাজ চিত হয়ে আছে, বাঁকা করে চার পা তুলে রেখেছে আকাশের দিকে।
মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে মাটির একেবারে কাছাকাছি, সিংহগুলোর ওপরে চলে এলো মুসা। থ্রটল পুরোপুরি খুলে রেখেছে। প্রচণ্ড গর্জন করছে এঞ্জিন। এইবার একটা সিংহীর টনক নড়লো। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আর এখানে থাকা নিরাপদ মনে। করলো না। প্লেনের দিকে চেয়ে একবার মুখ ভেংচে উঠে দাঁড়ালো, তার শাবকগুলোকে জড়ো করে হেলেদুলে এগিয়ে চললো কয়েকটা গাছের দিকে।
আবার ফিরে এলো মুসা।
বিরক্ত হয়ে চোখ মেললো বুড়ো সিংহটা। বিকট হাঁ করে হুঙ্কার ছাড়লো একবার। দূর, এখানে ঘুমানো যায় নাকি? যত্তোসব! এরকম একটা ভাব করে। উঠে দাঁড়ালো। রওনা হলো সিংহীটা যেদিকে গেছে সেদিকে। পরিবারের অন্যেরাও আর থাকলো না ওখানে। বুড়োর পেছন পেছন চললো।
ল্যাণ্ড করার জন্যে তৈরি হলো মুসা। প্রথমবার মাটিতে চাকা ছোঁয়াতে গিয়েও আবার তুলে ফেললো। সাহস হচ্ছে না। যদি ঝাঁকুনিতে ভেঙে পড়ে? দ্বিতীয়বারেও, পারলো না। তৃতীয়বারে আর ভাবলো না।
জোর ঝাঁকুনি লাগলো, তবে ভাঙলো না বিমান। মোটামুটি ভালোই ল্যাণ্ড করেছে। ঝাঁকুনি খেতে খেতে ট্যাক্সিইং করে ছুটলো। খানিক দূর এগিয়ে বিশাল এক গাছের মাত্র কয়েক ফুট দূরে আরেকবার জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে দাঁড়ালো বিমান, এঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে।
.
০৪.
মরার মতো এলিয়ে পড়েছেন টমসন। নাড়ি দেখলো কিশোর। খুব মৃদু চলছে। আশা আছে এখনও। তিনজনে মিলে ধরাধরি করে মাটিতে নামালো তাঁকে। কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে দৌড়ে এলো একটা লোক। কুচকুচে কালো এক নিগ্রো। পরনে হালকা রঙের ইউনিফর্ম। মাথায় মিলিটারিদের মতো ক্যাপ, ওটার পেছনে ঝুলছে পাতলা কাপড়ের কেপি, ঘাড় ঢেকে দিয়েছে–পোকামাকড়ের জ্বালাতন থেকে বাঁচার ব্যবস্থা। তিন গোয়েন্দার বুঝতে অসুবিধে হলো না, লোকটা একজন রেঞ্জার।
কি হয়েছে? ভাঙা ইংরেজিতে বলতে বলতে অচেতন দেহটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো সে।
বিষ মাখানো তীর, জানালো কিশোর।
ওয়ারডেনের বুকে কান রাখলো রেঞ্জার। মরেনি। জজের কাছে নিয়ে যাবো। ঠিক করে দেবেন।
জজ দিয়ে কি হবে? ডাক্তার দরকার।
জজই ডাক্তার। ভালো করে ফেলবেন।
জজের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করার প্রয়োজন মনে করলো না কিশোর। পকেট থেকে রুমাল বের করে বাধলো টমসনের হাতে, ক্ষতের কিছুটা ওপরে।
ওয়ারডেনকে বয়ে নিয়ে আসা হলো মূল কেবিনটাতে। ভেতরে কয়েকটা ভালো চেয়ার আছে, আর একটা বড় ডেস্ক। এই কেবিনেই ঘুমান তিনি, অফিসও এটাই। বিছানায় শোয়ানো হলো তাকে। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন ছোটখাটো একজন মানুষ।
এই যে, জজ এসেছেন, রেঞ্জার বললো। তিনি ঠিক করে দেবেন।
চেহারা আর চামড়ার রঙ দেখেই বোঝা গেল জজের বাড়ি এশিয়ায়, সম্ভবত ভারতে। অ্যাকসিডেন্ট? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
সংক্ষেপে জানালো রবিন।
আমি না থাকলে তো সর্বনাশ হতো, জজ বললেন। ভাগ্যিস এসে পড়েছিলাম। যাকগে, আর কোনো ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।
চুপচাপ জজকে দেখছে কিশোর। তার মনে হলো, টমসনের ভয়ানক বিপদে জজ মোটেও উদ্বিগ্ন নন। বরং যেন কিছুটা খুশিই লাগছে তাঁকে। কি জানি, হয়তো ওরকম হাসিখুশি স্বভাবই লোকটার। কিংবা হয়তো বুঝতে পারছেন, ভয়ের কিছু নেই, সেরে উঠবেন ওয়ারডেন।
প্রথমেই হাত থেকে দ্রুত রুমালটা খুলে ফেলে দিলেন তিনি।
এটা কি করলেন? বলে উঠলো কিশোর। রক্তে বিষ আরও বেশি ঢুকে যাবে না?
যা গেছে তা গেছেই, শান্ত কণ্ঠে বললেন জজ। আরও যাতে যেতে পারে সে-জন্যে খুলোম। এক জায়গায় আটকে রাখার চেয়ে সমস্ত সিসটেমে বিষ ছড়িয়ে দেয়াটাই ভালো। অ্যাকশন কমে যায় তাতে। বিশেষ করে অ্যাকোকেনথেরার।
এরকম থিওরি জীবনেও শোনেনি কিশোর। ভাবলো, কি জানি, এখানকার বিষের ব্যাপারে নিশ্চয় জজ সাহেব তার চেয়ে ভালো বোঝেন। তর্ক করলো না। বললো, ডিসটিলড ওয়াটার দিয়ে ধুয়ে নিলে ভালো হতো না?