তা যায়। কিন্তু নাগালই তো পাবে না, ঠিকই বলেছেন টমসন। তার আর কো-পাইলটের মাঝের সীটে দুই ফুট ব্যবধান। আহত হাতটা রয়েছে আরও দূরে। ওখানে পৌঁছতে হলে যন্ত্রপাতির ওপরে ঝুঁকে হাত বাড়াতে হবে, মুসাকে, প্লেন নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে পড়বে। রবিন রয়েছে আরও দূরে, তার পক্ষে আরও কঠিন।
আমি পারবো, কিশোর বললো। বলুন, কি করতে হবে।
এক মুহূর্ত ভাবলেন- টমসন। টেনে বের করতে পারবে না, ফলা আটকে যাবে। দেখো, মাথাটা ভাঙতে পারো কিনা।
পাইলটের সীটের ওপর দিয়ে ঝুঁকে এক হাতে তীরের মাথা, অন্য হাতে ডাণ্ডাটা চেপে ধরলো কিশোর। চাপ দিলো। আরে! যা ভেবেছিলো তা তো নয়। যথেষ্ট শক্ত। আরও জোরে চাপ দিলো সে। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল হাত, পিছলে যাচ্ছে। ধরে রাখতে পারছে না। ঘামতে শুরু করেছে দরদর করে। না, গরমে নয়, টমসনের কি রকম কষ্ট হচ্ছে সেকথা ভেবে। নিশ্চয় ভীষণ ব্যথা পাচ্ছেন। কিন্তু টু শব্দ করলেন না তিনি।
মট করে ভাঙলো অবশেষে। আলাদা হয়ে গেল তীরের মাথা। এবারের কাজ আরও জটিল। তাড়াতাড়ি ডাণ্ডাটা বের করে আনা।
ভাণ্ডা ধরে হ্যাঁচকা টান মারলো কিশোর। খুললো না ওটা।
রক্তাক্ত হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে রবিনের দিকে ফিরলো। কিশোর। দেখো তো, ওঁর হাতটা ধরতে পারো, কিনা? নাগাল পাবে?
উঠে চেষ্টা করে দেখলো রবিন। প্লেনের ভেতরে জায়গাই নেই। পারলো না।
আবার একা কিশোরকেই চেষ্টা করতে হলো। ডাণ্ডাটা ধরে দাঁতে দাতে চেপে আবার মারলো টান। কন্ট্রোলের ওপর থেকে হাত নড়ে গেল টমসনের। দুলে উঠলো প্লেন। কিন্তু যেখানের ডাণ্ডা সেখানেই রইলো। তাড়াতাড়ি প্লেনটাকে সামলালেন তিনি।
হাড়ে আটকে গেল না তো? গলা কাঁপছে রবিনের। দেখো আরেকবার টেনে।
মুসার আশা ছিলো, বড় হয়ে সার্জন হবে, এখানেই বাদ দিয়ে দিলো সেই ভাবনাটা। মানুষের এসব কষ্ট দেখলে সহ্য হয় না তার।
তৃতীয়বার টান দিলো কিশোর। লাভ হলো না। শেষে মরিয়া হয়ে ডাণ্ডাটা ধরে ওপরে-নিচে করে, আশেপাশে নেড়ে ছিদ্রটা বড় করতে লাগলো। মানুষটাকে কতোখানি ব্যথা দিচ্ছে কল্পনা করে তার নিজেরই বুক ধড়ফড় শুরু হয়েছে। শেষ। পর্যন্ত আরেকবার ধরে গায়ের জোরে দিলো টান, ছাড়লো না, টানতে লাগলো।
খুলে এলো ডাণ্ডাটা।
মুখ খুললেন টমসন। কিশোর ভাবলো বজ্জাত ছেলে বলে তাকে গাল দেবেন ওয়ারড়েন। কিন্তু শান্ত কণ্ঠে বললেন শুধু তিনি, গুড বয়!
ধপ করে সীটে এলিয়ে পড়লো কিশোর। হাঁপাচ্ছে, ঘামছে। কেনিয়ার প্রচণ্ড গরম তো আছেই, সেই সাথে ভয়ানক উত্তেজনা। চোখের সামনে ডাণ্ডাটা তুলে। দেখলো সে। ভাঙার মাথার কাছে লেগে রয়েছে লাল রক্ত আর কালো বিষ।
কিন্তু এতো কষ্ট করে তীরটা খুলে লাভ হবে তো? ওয়ারডেন কি বাঁচবেন? বিষ যা ঢোকার তা তো ঢুকেই গেছে রক্তে। সবই নির্ভর করে এখন তার দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর। এই বিষে শিশুরা কয়েক মিনিটেই মরে যায়। মহিলারা টেকে বড় জোর বিশ মিনিট। তবে, কিশোর শুনেছে, লড়াই করতে গিয়ে শত্রুর তীর খেয়ে দুই ঘন্টা বেহুশ হয়ে ছিলো একজন আফ্রিকান যোদ্ধা, তারপর ধীরে ধীরে সেরে উঠেছে।
আরও একটা ব্যাপার, বিষটা কতোখানি নতুন তার ওপরও নির্ভর করে অনেক কিছু। পুরনো হলে, ধুলো-ময়লা বেশি লেগে থাকলে কার্যক্ষমতা কমে যাবে অনেকখানি। মনে মনে প্রার্থনা করলো কিশোর, খোদা, তা-ই যেন হয়!
জয়স্টিকের ওপর ঢলে পড়লেন ওয়ারডেন। সঙ্গে সঙ্গে গোঁত্তা খেয়ে নাক পোচার নামিয়ে ফেললো বিমান, ধেয়ে চললো মাটির দিকে।
নিজের হাঁটুর ফাঁকে জয়স্টিকের আরেকটা অংশ ধরে জোরসে টান দিলো মুসা, সরাতে পারলো না। বেজায় ভারি টমসন। ভয়ঙ্কর গতিতে এগিয়ে আসছে। যেন ধরণী। চেঁচিয়ে উঠলো সে, জলদি সরাও ওকে!
নিচের দিকে ঝুঁকে গেছে বিমান। এই অবস্থায় কিশোর আর রবিনও সোজা হতে পারছে না। তাড়াতাড়ি সীটবেল্ট বেঁধে নিলো দুজনে। টমসনের কাধ ধরে টেনে সূরানোর চেষ্টা করলো কিশোর। রবিনের নাগালের মধ্যেই আসছে না তেমন, তবু কোনোমতে ওয়ারডেনের শার্টের কলার খামচে ধরে টানলো। মুসা চুপ। করে নেই; সে টেনে ধরে রেখেছে জয়স্টিক।
আস্তে আস্তে বেহুঁশ টমসনকে টেনে তুললো কিশোর আর রবিন।
দ্রুত এগিয়ে আসছে একটা লম্বা ক্যাপোক গাছ। চোখ বন্ধ করে স্টিকে টান মারলো মুসা। ভাবছে, গাছের সঙ্গে বাড়ি লাগলে মরতে কি খুব কষ্ট হবে? বাড়ি লাগলো না। শেষ মুহূর্তে শ করে গাছের ওপর দিয়ে বেরিয়ে এলো প্লেন।
ধরে না রাখলে আবার হেলে পড়ে যাবেন টমসন। দুদিক থেকে তাকে ধরে রেখেছে কিশোর আর রবিন। মুসা প্লেন সামলাতে ব্যস্ত। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলের দিকে। গিজমোটা কোথায়, যেটা ব্রেক নিয়ন্ত্রণ করে? জার্মান বিমানের ফুট প্যাডাল কি কি কাজ করে? চাপ দিতে গিয়েও পা সরিয়ে আনলো সে, সাহস হলো না। উড়ে চলা সহজ, কিন্তু ওঠানো নামানো খুব কঠিন কাজ। পারবে? নামাতে পারবে? এছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। ওদের। চারজনের জীবন নির্ভর করছে এখন তার হাতে। যা করে আল্লাহ! ভেবে, তৈরি হয়ে গেল ল্যাণ্ডিঙের জন্যে।
ল্যাণ্ডিংফীল্ডটা খুঁজলো তার চোখ। সারি সারি কেবিন দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু অ্যাসফল্টে বাঁধানো কোনো রানওয়ে চোখে পড়লো না। অবশেষে উইণ্ড-সকটা দেখতে পেলো। উড়ে গেল সেদিকে। রানওয়ে নেই। ঘাসে ঢাকা লম্বা এক চিলতে জমি। ওটাতেই বোধহয় নামানো হয় এই প্লেন।