এবার নড়লো পোচাররা। তবে মাসাইদের বিরুদ্ধে নয়। চারপাশ থেকে ঘিরে ফেললো তাদের নিজের নেতাকেই। গুলিতে আহত হলো আরও কয়েকজন। পরোয়া করলো না। সিলভারের হাত থেকে রিভলভার কেড়ে নিয়ে কিল-ঘুসি মারতে মারতে মাটিতে শুইয়ে ফেললো তাকে। টমসন আর মাসাইরা বাধা না দিলে মেরেই ফেলতো লোকটাকে।
ওঠো, আদেশ দিলেন ওয়ারডেন।
কম্পিত পায়ে উঠে দাঁড়ালো সিলভার। বিড়বিড় করে গাল দিচ্ছে। চোখ লাল। তিন গোয়েন্দার দিকে চোখ পড়তে আর সামলাতে পারলো না নিজেকে। ঘুসি পাকিয়ে ছুটে এলো ওদের দিকে।
খানিক দূরে বসে উৎসুক চোখে গণ্ডগোল দেখছিলো সিমবা। নিজে কিছু, করার সুযোগ পাচ্ছিলো না। এইবার পেলো। বাপ-দাদার অনুকরণে হিংস্র গর্জন ছেড়ে ধেয়ে এলো তীব্র গতিতে। সিলভারের বুকে দুপা তুলে দিয়ে গলায় কামড় বসাতে গেল।
কিছুই বললো না মুগামবি। কিন্তু বাধা দিতে ছুটে গেল মুসা। না না, সিমবা! সি-ম-বাআ! ওটার কলার চেপে ধরে টান দিলো।
ভীষণ রেগেছে আজ বুনো কুকুরের বংশধর। ঝাড়া দিয়ে মুসার হাত থেকে বেল্ট ছাড়িয়ে নিয়ে আবার কামড় বসাতে গেল। ধস্তাধস্তি করতে করতে মাটিতে চিত হয়ে পড়লো সিলভার। লম্বা হয়ে তার গায়ের ওপর সেটে এলো সিমবা, শিকারকে পাকড়াও করে খুন করার আগে যেভাবে চেপে ধরে বুনো কুকুর, তেমনিভাবে।
এই বার এসে হাত লাগালো মুগামবি। অনেক কসরত করে টেনে সরালো কুকুরটাকে। এখন আদরে কাজ হবে না, জানা আছে তার, ঠাস ঠাস করে কষে দুই থাপ্পড় লাগালো সিমবার মাথার দুই পাশে। শান্ত হলো কুকুরটা।
কোনোমতে উঠে বসলো সিলভার। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো। ডলছে আহত জায়গাগুলো।
তোমার খেল খতম, সিলভার, ওয়ারডেন বললেন। অনেক জ্বালান। জ্বালিয়েছো..ভাগ্যিস তিন গোয়েন্দাকে পেয়েছিলাম…
আমার কচুটাও করতে পারবে না তুমি, বুড়ো আঙুল দেখালো সিলভার, তেজ কমেনি। অনেক টাকা আছে আমার। টাকার জোরে পার পেয়ে যাবো।
আদালতে গিয়ে জজ নির্মল পাণ্ডাকে বলো সেকথা। তোমার ছাল ছাড়িয়ে নেবে। জানোয়ার তো মেরেছোই, সেই সঙ্গে মানুষ খুনও করেছো। তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে নির্মল। দুনিয়ার সব টাকা দিলেও তার হাত থেকে নিস্তার পাবে না।
জোরে হেসে উঠলো সিলভার।
তার হাসি শুনে আবার রেগে গেল সিমবা। ঝাড়া দিয়ে বেল্ট ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে যেতে চাইলো। কিন্তু মুগামবির সঙ্গে পারলো না।
এখনও পাণ্ডা পাণ্ডা করছেন, স্যার? গম্ভীর হয়ে ওয়ারডেকে বললো। কিশোর। কথা শুনেও কিছু বুঝতে পারছেন না? অনেকখানি বদলে ফেলেছে বটে চেহারা, কণ্ঠস্বর কিন্তু পুরোপুরি ঢাকতে পারেনি। এতোদিনের বন্ধু আপনার, এতো ঘনিষ্ঠতা, তা-ও চিনতে পারছেন না?
অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকালেন টমসন। কি বলছো?
ঠিকই বলছি, সিলভার কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাত বাড়িয়ে তার দাড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান মারলো কিশোর। খুলে এলো নকল দাড়ি বেরিয়ে পড়লো জজ নির্মল পাণ্ডার মুখ।
স্তব্ধ হয়ে গেলেন ওয়ারডেন। কথা সরছে না মুখে।
হা হা করে হাসলো জজ। কেন ঘাবড়াইনি বুঝতে পারছো তো? আমি জজ, আদালতে আমার বিচার আমিই করবো। তুমি একটা আস্ত গাধা, ওয়ারডেন। হাহ হাহ হা!
হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নাইরোবি পুলিশের হাতে পড়ার পরই শুধু নরম হলো জজ নির্মল পাণ্ডা, যখন দেখলো ঘুষ খায় না, এমন লোকও আছে। কোটি কোটি টাকার লোভ দেখিয়েও যাকে দিয়ে অন্যায় করানো যায় না। ওখানকার জজকে কিনতে পারলো না সে। যাবজ্জীবন জেল হয়ে গেল। অন্যায়ভাবে অর্জিত তার সমস্ত টাকা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে দান করে দেয়া হলো আফ্রিকান ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটিকে।
নিজের মুখে সব কুকর্মের কথা স্বীকার করেছে নির্মল পাণ্ডা, তবু যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না ওয়ারডেন টমসন। ওরকম নিরীহ চেহারার হাসিখুশি একজন ভদ্রলোক এতো খারাপ হতে পারে, কল্পনাই করেননি তিনি কোনোদিন। সব। চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছেন, একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হারিয়েছেন বলে, অন্তত তিনি নিজে জজ নির্মল পাণ্ডাকে বন্ধু হিসেবেই নিয়েছিলেন।
.
ফেরার দিন এলো তিন গোয়েন্দার। স্টর্ক বিমানটা ঠিক হয়ে গেছে। তাতে চড়েই, নাইরোবি যাবে ওরা। সেখান থেকে জেট লাইনারে চড়ে আমেরিকায়।
ওয়ারডেন টমসন যেতে পারবেন না ওদের সঙ্গে। জরুরী কাজ আছে। তাছাড়া জায়গাও নাকি হবে না বিমানটায়। কেন হবে না, বুঝতে পারলো না তিন গোয়েন্দা। প্রশ্ন করেও কোনো জবাব মিললো না, শুধু রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলেন তিনি।
নির্দিষ্ট দিনে বিমানটায় উঠলো তিন গোয়েন্দা, পাইলটের সীটে অবশ্যই মুসা আমান। উঠেই অবাক হয়ে গেল। তার পেছনের সীটের পায়ের কাছে আরাম করে শুয়ে ছিলো বুনো কুকুরের বংশধর, সাড়া পেয়ে লাফিয়ে উঠে বসলো সীটে। মৃদু গাউ করে উঠলো। স, আরি, তুই! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। তুই এখানে কি করছিস? যা যা, নাম। আমরা চলে যাচ্ছি।
না, ও-ও যাচ্ছে তোমাদের সঙ্গে, নিচে থেকে হাসিমুখে বললেন ওয়ারডেন। পাশে দাঁড়ানো মুগামবির দিকে একবার চেয়ে আবার ফিরলেন কিশোর বৈমানিকের দিকে। আমার তরফ থেকে, মুগামবির তরফ থেকে, আফ্রিকান ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটির তরফ থেকে তিন গোয়েন্দাকে উপহার। অনেক করেছো তোমরা। উপহার দিয়ে সেই ঋণ শোধ করা যাবে না। এই সামান্য উপহারটুকু নিলে আমরা সবাই খুশি হবো।