নাইরোবিতে মেকানিকের জন্যে তার পাঠিয়ে দিয়েছেন ওয়ারডেন। প্লেনের ভাবনা এখন আর আমাদের নয়। গিয়ে গর্তগুলো খুঁজে বের করতে হবে।
বিশ মাইল দূরে সেই বাওবাব ওরফে জলহস্তী গাছের জঙ্গল। আগের দিনের মতোই নির্জন। হঠাৎ, চাপা একটা শব্দ শোনা গেল। মানুষের কণ্ঠস্বর। মনে হলো, মাটির নিচ থেকে আসছে।
ঝোপঝাড়ের মাঝে ফাঁকা জায়গাগুলো দেখে মাসাইরা জানালো, হাতি ধরার ফাঁদই তৈরি করা হয়েছে ওসব জায়গায়। ওপরের ডালপাতা সরানো বিপজ্জনক। পোচাররা নিচে থেকে থাকলে, সরানোমাত্র তীর ছুঁড়তে পারে।
উবু হয়ে শুয়ে সাবধানে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল কয়েকজন মাসাই। একটা গর্তের কিনারে পৌঁছে আলগা ডালপাতা ধরে টেনে সরালো, ফাঁক করে উঁকি দিলো নিচে। কোনো তীর কিংবা বল্লম ছুটে এলো না ওদের দিকে। সামনে মুখ বাড়িয়ে আরও ভালোমতো দেখলো। কেউ নেই।
এক এক করে সবগুলো গর্ত দেখা হলো। কোনোটাতেই মানুষ নেই। কিন্তু মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।
ভয় পেয়ে গেল মুসা। খাইছে! ভূত নাকিরে বাবা! নির্ভীক বৈমানিকের এহেন উক্তি শুনে না হেসে পারলেন না ওয়ারডেন।
কিশোর নীরব। কান পেতে শুনছে। কোনো সন্দেহ নেই, মানুষেরই কণ্ঠস্বর। গর্তে নেই, ঝোপের ভেতরে নেই আসছে কোথা থেকে তাহলে? চিন্তিত ভঙ্গিতে বাওবার গাছগুলোর দিকে তাকালো সে। ওগুলোতেও ঘন ডালপাতা নেই, যার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে মানুষ। তাহলে?
পায়ে পায়ে একটা গাছের কাছে চলে এলো গোয়েন্দাপ্রধান। থেমে গেল কথা বলা, আর কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মাসাইরাও নীরব। একটা মোটা গাছের চারপাশে ঘুরে এলো সে, নেই কেউ।
হতাশ হয়ে প্রায় হাল ছেড়ে দিতে যাচ্ছিলো কিশোর, হঠাৎ পেছনে ফিসফিস করে বলে উঠলো রবিন, কিশোর, এক মিনিট। আমার মনে হয় ব্যাটারা এখানেই আছে।
আছে? কোথায়?
কোনো রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারলে, সেটা রবিন। আর মুসা না। বুঝলে তাদের দিকে যেভাবে চেয়ে মিটিমিটি হাসে কিশোর, এখন ঠিক তা-ই করলো রবিন। নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো, অনুমান করো।
তার চেয়ে কেউ বেশি জানুক, এটা সইতে পারে না কিশোর। ভোঁতা কণ্ঠে বললো, জানি না…না না, দাঁড়াও! তুড়ি বাজালো। বুঝেছি!
কোথায়? মুসাও এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।
এই গাছগুলোর কাণ্ড কতো মোটা দেখেছো? মুসাকে বললো রবিন। পাশ ফুটের বেশি উঁচু হয় না বাওবাব, কিন্তু পাশে বাড়ে। বেঁটে, অসম্ভব মোটা মানুষের মতো কুৎসিত হয়ে যায়। পেটের বেড় হয়ে যায়, ষাট ফুটের ওপর।. এই যে, এগুলোর বেড় আরও বেশি মনে হচ্ছে। নিশ্চয় অনেক পুরনো, পাঁচশো থেকে হাজার বছরের, সেজন্যেই এতো মোটা। মজা হলো, পাশে যতো বাড়তে থাকে, পুরনো বাওবাবের ভেতরটা ততো ফোপরা হয়ে যায়। একেবারে খালি কোঠা। বিশজন মানুষ অনায়াসে থাকতে পারে।
কিন্তু ঢুকলো কোন দিক দিয়ে? গাছগুলোর ওপরে-নিচে আবার তাকালো। মুসা। ফোকর-টোকর তো দেখছি না।
ডাল যেখান থেকে ছড়িয়েছে।
ঢোকার মুখ ওখানে? হাত তুলে একটা গাছ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা। গাছটার ডালগুলো ছড়িয়েছে মাটির বারো ফুট ওপর থেকে। রবিন জবাব দেয়ার আগেই হাত নেড়ে মুগামবিকে ডাকলো সে।
কাছে এসে দাঁড়ালো বিশালদেহী মাসাই। তার কাঁধে চড়ে একটা ডাল ধরে ফেললো মুসা। পায়ের ব্যথা অনেক কম, নাড়াচাড়া করলেও আর তেমন লাগে না। এখন। ডালে উঠে লম্বা হয়ে শুয়ে ক্রল করে নিচের দিকে এগোলো। সবগুলো ডাল যেখানে মিলিত হয়েছে, ঠিক তার মাঝখানে বড় একটা কালো ফোকর। ওটার কাছে এসে সাবধানে মুখ বাড়ালো সে, নিচে উঁকি দিলো।
আশা করেছিলো, তীর ছুটে আসবে একঝাঁক।
কিছুই এলো না। ভেতরের বিষণ ছায়ায় দেখা গেল অনেকগুলো কালো মুখ। ওপর দিকে চেয়ে আছে। দুষ্টুমি করতে গিয়ে ধরা পড়লে বাচ্চা ছেলে যেরকম করে, অনেকটা সেরকম ভাবসাব।
সরে এসে আবার মুগামবির কাঁধে নামলো মুসা। সেখান থেকে মাটিতে।
গাছের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো পোচাররা। টপাটপ লাফিয়ে। পড়লো মাটিতে। খালি হাতে বেরিয়েছে, অস্ত্রশস্ত্র সব রেখে এসেছে। গাছের ভেতরে। আক্রমণের ইচ্ছে নেই, পালানোরও নয়। সম্পূর্ণ পরাজিত, আত্মসমর্পণ করতে বেরিয়েছে।
এগিয়ে এলেন ওয়ারডেন। বললেন, মুগামবি, জিজ্ঞেস কর তো, এতো ভালো হয়ে গেল কেন হঠাৎ?
সোয়াহিলি ভাষায় জিজ্ঞেস করলো মুগামবি। জবাব দিলো নেতা গোছের একজন পোচার। ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনালো সেটা মাসাইদের সর্দার, ওরা আর লড়াই করতে চায় না। একাজ ছেড়ে দিতে চায়।
কেন?
অনেক কষ্ট করে ফাঁদ পাতে ওরা, কুঁড়ে বানায়। বার বার আমরা গিয়ে নষ্ট করে দিই। গত কিছু দিন ধরে একটা ফাঁদ থেকেও কিছু আয় করতে পারেনি। ওরা। খালি সিলভারের ধমক-ধামক শুনেছে। ওদের সঙ্গে তার চুক্তি, মাল দেবে, টাকা নেবে। দিতেও পারেনি, নিতেও পারেনি। অহেতুক গাধার খাটনি খাটতে আর রাজি নয় ওরা।
নেতা গোছের লোকটা অন্যান্য গাছের দিকে চেয়ে জোরে জোরে কি বললো।
আরও কয়েকটা গাছ থেকে বেরিয়ে এলো অনেক পোচার। একটা গাছ থেকে কয়েকজন পোচারের সঙ্গে বেরোলো স্বয়ং লঙ জুন সিলভার, কিন্তু সে আত্মসমর্পণ করবে না। দুই হাতে দুই রিভলভার, দাড়িতে ময়লা, রাগে দুদিকে সরে গেছে। ঠোঁটের দুই কোণ। চেঁচিয়ে লড়াই করার আদেশ দিলো. পোচারদের। ওরা, কথা। শুনছে না, দেখে লাফাতে শুরু করলো। রিভলভার তুলে গুলি ছুড়লো আকাশে। তারপরও শুনছে না দেখে কেউ বাধা দেয়ার আগেই গুলি করে মেরে ফেললো একটা লোককে। বব্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে যেন।