বেশিক্ষণ থাকতে হবে না তোমাদের, কম্পাস, ম্যাপ আর ওয়াটার বটল গুছিয়ে নিতে নিতে হাসলো কিশোর। মাত্র তো পঞ্চাশ মাইল। সকাল-বিকাল তোমার সঙ্গে দৌড়ে দৌড়ে আজকাল ভালোই হাঁটতে পারি আমি, জানো। বারো-চোদ্দ ঘন্টার বেশি লাগবে না। তারপর ট্রাক নিয়ে ফিরে আসতে, ধরো, আরও দুই ঘন্টা। আমার বিশ্বাস, ওই মোল ঘন্টা বেঁচে থাকতে পারবে তোমরা।
কিন্তু, বিকেল হয়ে গেল, রবিন বললো। রাতে হাটবে? কাল সকালে গেলে হতো না?
রাতে হাঁটাই সুবিধে, আবহাওয়া ঠাণ্ডা। চাঁদও থাকবে। ভেবো না, আমি ঠিকই চলে যাবো। হুঁশিয়ার থেকো। সকালে ফিরে আসছি আমি।
কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘুরলো কিশোর। পেছন থেকে ডেকে বললো মুসা, এই শোনো, ভালো দেখে কয়েকটা স্যাণ্ডউইচ নিয়ে এসো। সারারাত হায়েনা তাড়িয়ে সকালে আমি নিজেও হায়েনা হয়ে যাবো।
হেসে উঠলো তিনজনেই।
.
বেলা ডুবতেই ঠাণ্ডা হয়ে এলো গরম বাতাস। বন থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো। নিশাচর জানোয়ারেরা। প্রায় সবাই আগ্রহ দেখালো প্লেনটার প্রতি। পায়ে পায়ে এসে জমা হতে লাগলো–কেউ বসলো, কেউ দাঁড়িয়ে রইলো, চারপাশ ঘিরে। ভীতু যারা, দূরে রইলো। সাহসীরা এগিয়ে এলো। বেশি সাহসী কেউ কেউ এসে বিমানে উঠে সঙ্গী হতে চাইলো দুই গোয়েন্দার। ডানায় চড়ে বসলো বেবুনের দল। জানালায় নাক ঠেকিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলো ভারভেট মাংকি।
চারটে গণ্ডার এসে হাজির হলো প্লেনের কাছে। বার কয়েক নাক টানলো, ঘোৎ ঘোঁৎ করলো। তেড়ে এলো একটা। কিন্তু আজব জানোয়ারটাকে নীরব। দেখে মাঝপথে থেমে আবার ফিরে গেল সঙ্গীদের কাছে। ব্যাটাকে নিয়ে কি করা। যায়, সেই আলোচনা চালালো যেন।
গণ্ডারগুলো যেন বোঝাতে চাইছে, তাদের এলাকায় থাকার কোনো অধিকার নেই এই আজব জন্তুটার। মাথা নুইয়ে শিং বাগিয়ে তেড়ে এলো একসঙ্গে। স্টর্কটাকে ধ্বংস করার জন্যে একটা গণ্ডারই যথেষ্ট। সেই জায়গায় চারটে মিলে কি করতে পারবে, ভাবতেই গলা শুকিয়ে গেল দুই গোয়েন্দার। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইলো ওরা। প্লেন থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড় দেয়ার ইচ্ছেটা দমন করলো অনেক কষ্টে।
গণ্ডারগুলো কাছে এসে গেছে, এই সময় সংবিৎ ফিরলো যেন মুসার। উঠে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিয়ে জোরে জোরে চেঁচাতে শুরু করলো। রবিনও যোগ দিলো তার সঙ্গে।
থমকে গেল চার-দানব। ওরা বোধহয় মনে করলো, আজব জীবটাই বিচিত্র চিৎকার করছে। দ্বিধায় পড়ে গেল। একে আক্রমণ করা উচিত হবে কিনা ঠিক করতে পারছে না। ঘেৎ ঘোৎ করে ফিরে গেল আগের জায়গায়, আবার আলোচনা শুরু করলো।
গণ্ডারের মতো বদমেজাজী জানোয়ার আলোচনা করে একবার যে একমত হয়েছিলো, সে-ই বেশি। দ্বিতীয়বার আর পারলো না। তর্কাতর্কি করে নিজেরাই পোচার। লেগে গেল শেষে। প্রচণ্ড মারপিটের পর একেকটা চলে গেল একেক দিকে। হাঁপ ছাড়লো রবিন আর মুসা।
তীক্ষ্ণ নজর রেখে বিমানটার চারপাশে ঘুরছে গ্যাজেল হরিণ আর জিরাফ। ইমপালা হরিণেরা পেয়ে গেছে আরেক মজা। লাফিয়ে প্লেনের কে কতো ওপর দিয়ে যেতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় মেতেছে যেন। আড়াল থেকে বিদ্যুতের মতো বেরিয়ে এসে একটা হরিণের ওপর পড়লো চিতাবাঘ, মট করে ঘাড় ভেঙে ফেললো বেচারা প্রাণীটার।
সাঁঝের বাতাস চিরে দিলো একটা তীক্ষ্ণ চিত্তার। মুসা ভাবলো, মদ্দা হাতি। কিন্তু রবিনের জানা আছে ওটা কিসের ডাক, চিড়িয়াখানায় শুনেছে। ওরকম চিৎকার করতে পারে কোন প্রাণী, সেটা বইয়েও পড়েছে। গেছো হাইর্যাক্স। মাত্র ফুটখানেক লম্বা একটা নিশাচর জীব।
টুপ করে ঝরে গেল যেন গোধূলির শেষ আলোটুকুও। চাঁদ উঠতে সময় লাগবে। ঘন ছায়া নেমেছে বন, পাহাড় আর তৃণভূমি জুড়ে। কিলিমানজারোর তুষারে ছাওয়া চূড়াটাও ঢাকা পড়েছে অন্ধকারে। নীলচে-কালো আকাশের পটভূমিকায় এখন মস্ত এক ম্লান-ধূসর ছায়ামাত্র ওটা।
.
২১.
ঘুমানোর চেষ্টা করলো মুসা।
দূর! বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিলো। এরকম একটা সীটে ঘুমানো যায় নাকি? পা বাকা করে রাখতে হচ্ছে, তাতে ব্যথা আরও বেশি করছে। জানোয়ারের ভয় ইতিমধ্যে অনেকখানি কেটে গেছে। প্লেনের ডানার নিচে নরম ঘাসের বিছানা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারলো না গোয়েন্দা-সহকারী। ঝুঁকি নিয়েও নামলো নিচে।
ডানার নিচে ছায়া ছায়া অন্ধকার, উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার মাঝে বেশ প্রকট। ওখানেই গিয়ে শুয়ে পড়লো সে। আশা করলো, এখানে চোখ পড়বে না হাতি, গণ্ডার কিংবা মোষের।
তবে আরেকটা মহা-বিপজ্জনক প্রাণীর কথা বেমালুম ভুলে গেল সে। সর্বনেশে পিঁপড়ে।
খবর পৌঁছে গেল পিপিলিকার রাজত্বে। দল বেঁধে পিলপিল করে এসে হাজির। হলো ওরা। আরামেই ঘুমিয়ে ছিলো মুসা, কুট করে কামড় লাগলো আহত পায়ে। পাত্তা দিলো না। ভাবলো, যন্ত্রণার পরিবর্তন ঘটছে। হাতে-পায়ে-গলায়-মুখে। একসাথে আরও কয়েকটা কামড় লাগতেই চোখ মেললো। দেরি করে ফেলেছে বেশ।
বুকের ওপর ঢলে পড়েছিলো রবিনের মাথা। চিৎকার শুনে ঝট করে সোজা হলো। দেখলো, উন্মাদ-নৃত্য জুড়েছে মুসা আমান। শরীরের যেখানে-সেখানে। চাপড় মারছে, টেনে ছিঁড়ে খুলে ফেলার চেষ্টা করছে গায়ের কাপড়। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে।