আশেপাশে কোথাও পোচারদের একটা কুঁড়ে চোখে পড়লো না। জনমানবের ছায়াও নেই। গর্ত থাকলে ঝোপঝাড়গুলোর মাঝেই আছে, নিচে লুকিয়ে রয়েছে পোচাররা।
নিচে না নামলে বোঝা যাবে না, কিশোর বললো। লজে ফিরে চলো। লোক নিয়ে আসবো।
আরও মিনিট দশেক ঠিকমতোই চললো বিমান। তারপর শুরু করলো গোলমাল। নাচছে, দুলছে, কাত হয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে। পাড় মাতাল হয়ে গেছে। যেন।
ব্যাপার কি? বুঝতে পারছে না রবিন। পকেট?
নাহ, উঁকি দিয়ে বিমানের শরীরের বাইরের অংশ দেখার চেষ্টা করছে কিশোর। এয়ার পকেট নয়। তাছাড়া এখানে থাকার কোনো কারণ দেখছি না। অন্য কিছু হয়েছে।
সেটা কী? মুসা, কন্ট্রোলে কোনো গণ্ডগোল?
কি জানি। আমি কোথাও নড়চড় করিনি।
কিন্তু কিছু একটা তো হয়েছে!
ভীত ঘোড়ার মতো নাচতে শুরু করেছে এখন প্লেন।
ওই দেখো, চেঁচিয়ে বললো কিশোর। ডানের ডানাটা কেমন ঝুলে যাচ্ছে!
থরথর করে কাঁপছে ডানাটা, ঝরা পাতার মতো খসে উড়েই যাবে বুঝি যে কোনো মুহূর্তে।
বিমানের নাক সোজা রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে মুসা, সম্ভব হচ্ছে না। কথাই শুনতে চাইছে না যেন ওটা। উঁচু একটা ক্যাােেক গাছের ওপর দিয়ে শা করে বেরিয়ে এলো, আর সামান্য নিচে নামলেই বাড়ি লেগে ছাতু হয়ে যেতো। বেড়ে গেছে দুলুনি।
কিছুতেই সামলাতে পারছি না, মুসার গলা কাঁপছে। ক্র্যাশ করবেই। তৈরি থাকো তোমরা। দরকার হলে লাফিয়ে পড়তে হবে।
বিমানের নাক নিচের দিকে। ধাক্কা লাগানোর জন্যে দ্রুত ধেয়ে আসছে যেন। মাটি। ইগনিশন অফ করে দিলো মুসা। এঞ্জিন বন্ধ, নিজের ইচ্ছেয় ছুটছে বিমান। চাকা লাগলো মাটিতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি…তীক্ষ্ণ একটা শব্দ, ছিঁড়ে পড়ে গেল ডান ডানা…বড় একটা উইয়ের ঢিবিতে তো লাগিয়ে স্থির হয়ে গেল প্লেন।
যাক, বাঁচলাম! ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো মুসা।
বাঁচার কি হলো? চেঁচিয়ে বললো রবিন।
আগুন লাগেনি। মরিনি আমরা। বাঁচলাম না?
বাঁচলাম বলা যাবে না এখনও। বেঁচে নামলাম। লজে ফিরে যেতে না পারলে..এই কিশোর, কি ভাবছো? কিছু বলছো না কেন?
উ! ফিরে তাকালো কিশোর। কি বলবো? ডানা ছেঁড়ার ব্যাপারটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। কেন ছিড়বে?..চলো, নেমে দেখি।
পঞ্চাশ ফুটু পেছনে পড়ে আছে ডানাটা। কাছে গিয়ে দাঁড়ালো তিন গোয়েন্দা। ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখলো কিশোর। বিড়বিড় করলো আনমনে, আপনা-আপনি ছেঁড়েনি। ছেঁড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মানে! অবাক হয়ে গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে তাকালো দুই সহকারী।
বুঝতে পারছো না? এই দাগটা দেখো। স্বাভাবিক ভাবে ছিড়লে এটা অন্য রকম হতো, এতো নিখুঁত, সোজা নয়। করাত দিয়ে কেটে দুর্বল করে রাখা। হয়েছিলো ডানার গোড়া, যাতে কিছুক্ষণ ওড়ার পরই ভেঙে পড়ে। সম্মানিত বোধ করছি, তিক্ত কণ্ঠ, বিরক্তিতে কুঁচকে গেছে মুখ। কেউ একজন আমাদের ইমপরট্যান্ট লোক ভাবতে আরম্ভ করেছে। তার পাকা ধানে যাতে মই দিতে না পারি সে-জন্যে খুন করতে চেয়েছে।
ছড়ে যাওয়া কনুই ডলছে রবিন। বাঁ হাঁটুতে হাত বোলাছে মুসা। টিপ দিয়েই উহ করে উঠলো।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
না, কিছু না। নামার সময় বাড়ি লেগেছে হয়তো। ফুলে গেছে। তো, এখন কি করা? প্লেনে তো রেডিও নেই। আগুন জ্বেলে সংকেত দেবো?
লাভ হবে না। লজ এখান থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে। এতো দূর থেকে কেউ দেখবে না। বরং যারা দেখবে, তারা পোচার। ছুটে আসবে। মরিনি দেখে খুশিই হবে। ওদেরকে জ্বালানোর শোধ তুলবে আমাদের ওপর।
তাহলে কি করবো? রবিন বললো। এখানেই বসে থাকবো? আমাদেরকে ফিরতে না দেখে খুজতে আসবে ওয়ারডেনের লোক।
আসবে বলতে পারি না, তবে খুঁজতে বেরোবে। একশো মাইল বুনো এলাকায় আমাদের খুঁজে বের করতে ওদের কহপ্তা লাগবে কে জানে! যখন পাবে, কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। একটাই উপায় আছে এখন। হেঁটে লজে চলে যাওয়া।
ব্যাগ-ট্যাগগুলো নেয়ার জন্যে প্লেনে ফিরে চললো ওরা। কিশোর লক্ষ্য করলো, সাংঘাতিক খোঁড়াচ্ছে মুসা। আরি, তোমার পায়ের অবস্থা তো খুব খারাপ। ভাঙেনি তো?
না।
কিন্তু পঞ্চাশ মাইল হাঁটতে তুমি পারবে না।
পারবো, পারবো। চলোই না।
কি করে পারবে? পঞ্চাশ ফুটই তো. পারছে না। বেশি চাপাচাপি করলে আরও ফুলবে। বয়ে নিতে হবে শেষে। তোমাকে বয়ে নেয়া আমার আর রবিনের কম্মো নয়।
তাহলে?
তুমি আর রবিন প্লেনেই থেকে যাও। আমি একাই যেতে পারবো।
আরে দূর, কি যে বলো। রবিনকে তুমি নিয়ে যাও। আমি একলা থাকতে পারবো। প্লেনে বসে বসে জাস্ট ঘুমাবো, হাসলো মুসা, তাতে যন্ত্রণার ছাপ।
না, আমি একা যাবো। প্লেনটাকে দেখার জন্যেও এখানে কাউকে থাকা দরকার। জখমী পা নিয়ে তুমি কিছু করতে পারবে না। রবিনকে থাকতেই হচ্ছে।
প্লেনটাকে দেখার আর কি আছে? আফ্রিকান জানোয়ারে প্লেন খায় না।
খায়। পোচাররা এসে দামী যন্ত্রপাতি নষ্ট করতে পারে। হাতি আর গণ্ডারও কৌতূহলী হতে পারে। কিছুদিন আগে মারকিনস-এ একটা বিমান পড়েছিলো, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলো ওটাকে গণ্ডারে। হায়েনারা আরও এক কাটি বাড়া। রবার ওদের খুব প্রিয়, টায়ার খেয়ে ফেলে। আহত না হলেও বিমানটাকে বাঁচানোর জন্যে কাউকে এখানে থাকতে হতো।
ঠিক আছে, বললো অনিচ্ছুক মুসা। থাকবো। হারামি পা-টা ব্যথা পাওয়ার আর সময় পেলো না।