একেবারে আদিম পদ্ধতি, বিড়বিড় করলো রবিন। প্রাগৈতিহাসিক মানুষও ওভাবে ম্যামথ শিকার করতো।
আরও একটা কাজ করে পিগমিরা, রবিনের কথা যেন শুনতেই পায়নি গোয়েন্দাপ্রধান। জরুরী মুহূর্তে ওই গর্তকে বাংকার হিসেবেও ব্যবহার করে।
তারমানে, মুসা বললো। তুমি বলতে চাইছো, পোচাররাও হাতি ধরার গর্তকে বাংকার হিসেবে ব্যবহার করছে?
হ্যাঁ! আজ আর বেলা নেই। কাল সকালে এসে খুঁজবো।
লজে ফিরে দেখলো ওরা, জজ নির্মল পাণ্ডা হাজির।
এই যেছেলেরা, দেখেই হাসিমুখে বলে উঠলেন তিনি। খুঁজে পেয়েছো?
এখনও পাইনি। তবে পাবো, গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো কিশোর।
যাবে কোথায় শুয়োরের বাচ্চা? ইচ্ছে করেই গালিটা দিলো মুসা। আড়চোখে তাকালো জজের দিকে।
আমি হলে হাল ছেড়ে দিতাম, হাসি বিন্দুমাত্র মলিন হলো না জজের। তোমরাও ছাড়বে। এখনও বুঝতে পারছে না তো। আমরা কি আর কম চেষ্টা করেছি, কম খুঁজেছি? পাইনি। দেখো, চেষ্টা করে দেখো। পেলে তো ভালোই।
কিশোরের মনে হলো, জজের কথাবার্তা আর হাসির পেছনে কি যেন একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে। রাগে মুসার মতোই গাল দিয়ে উঠতে যাচ্ছিলো, অনেক কষ্টে সামলালো নিজেকে। শান্তকণ্ঠে বললো, আপনার মহানুভবতার কথা বলেছেন আমাকে মিস্টার টমসন। ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটিকে নাকি অনেক টাকা দান করেছেন।
বিগলিত হলো জজের হাসি, হাত নাড়লো বিনীত ভঙ্গিতে। ও কিছু না.। নেই তো, দেবো কোত্থেকে? ইচ্ছে করে দুনিয়ার সমস্ত ধন এনে লাগাই অসহায় অবলা জানোয়ারগুলোর উপকারে। কিন্তু কয় পয়সা আর বেতন পাই বলো? তা থেকেই কষ্টেসৃষ্টে জমিয়ে যা পেরেছি দিয়েছি।
খুব ভালো, খুব ভালো, আপনার অনেক দয়া। তবে ইচ্ছে করলে অনেক বেশি টাকা কামাতে পারেন। এদেশের অনেক জজ সাহেবই সেটা করছেন।
মানে? কালো হয়ে গেল জজের মুখ। হাসি উধাও।
ধরুন–মানে, আমি কল্পনা করতে বলছি আরকি আপনাকে আপনি মোটেই সৎ লোক নন। ভদ্রলোক নন, নিতান্তই ছোটলোক। পোচারদের সঙ্গে আপনার যোগসাজশ আছে। পোচারদের ধরে আপনার কোর্টে পাঠালে নানারকম অজুহাত দেখিয়ে বেশির ভাগকেই ছেড়ে দেন, অল্প কয়েকজনকে লোক দেখানো শাস্তি দেন, এই দুচার দিনের জন্যে। শহরে যতো বড় বড় অন্যায় ঘটে, সব দেখেও না, দেখার ভান করেন। কেন করেন? দুহাত ভরে টাকা দেয়া হয় আপনাকে, বিনিময়ে। কালো টাকার পাহাড় জমিয়ে ফেলছেন। অথচ এমন ভাব করে থাকেন, যেন আপনার মতো সৎ লোক আর হয় না, সবার জন্যে দরদ উথলে পড়ে। মাঝে মাঝেই টাকা দান করেন ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটিতে, যাতে আপনার ওপর সন্দেহ না পড়ে কারও।
রাগে লাল হয়ে গেছে জজের মুখ। মোলায়েম দৃষ্টি আর মোলায়েম নেই, যেন ইস্পাতের তলোয়ারের ধারালো ফলার চোখা মাথা। কিশোরের হৃৎপিণ্ডে বেঁধার চেষ্টা করছে। জোর করে শুকনো হাসি ফোঁটালেন মুখে। খুব কল্পনাপ্রবণ ছেলে তুমি। আমার মতো নিরীহ, জানোয়ার, দরজার দিকে চোখ পড়তে থেমে গেলেন।
খোলা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সিমবা। মুসাকে খুঁজতেই এসেছিলো বোধহয়, জজ সাহেবকে দেখে রেগে গেছে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। চাপা ঘড়ঘড় করতে করতে ঘরে ঢুকলো।
কি ভেবে জ্বলে উঠলো কিশোরের চোখ। দুই সহকারীকে বললো, চলো, যাই।
অবাক হলো রবিন আর মুসা, কিন্তু কিছু বললো না। কিশোরের এই অদ্ভুত
ব্যবহারের নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। পিছু পিছু বেরিয়ে এলো ওরা।
ঠোঁটে আঙুল রেখে ওদেরকে চুপ থাকতে বলে জানালার কাছে গিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি দিলো কিশোর।
বাঘের দৃষ্টিতে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছেন জজ। দরজার মুখে বসে, আছে ওটা। জোরে জোরে হাত নেড়ে ওটাকে ভাগার নির্দেশ দিলেন। নড়লো না সিমরা। গোঁ গোঁ করে উঠলো। দাঁত খিচালো আরেকবার! টেবিলে জোরে কিল মারলেন জজ। তারপর ছুটে গিয়ে ধা করে এক লাথি মারলেন কুকুরটার গলায়। আর যায় কোথায়। গাউক করে এসে তার বুকে দুপা তুলে দিলো সিমবা। টুটি কামড়ে ধরতে গেল। চোখের পলকে ছুরি বেরিয়ে এলো নিরীহ জজের হাতে। শিকারী কুকুরের বংশধর সিমবা, অসাধারণ ক্ষিপ্র। পেটে ছুরি বেঁধার আগেই লাফ দিয়ে সরে গেল। পরমুহূর্তে কামড়ে ধরলো জজের ছুরি ধরা হাত। ছুরিটা ফেলার পর তবে ছাড়লো।
হেরে গিয়ে ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন জজ। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পুরো এক মিনিট চাপা গলায় গর্জালো বুনো-কুকুরের বাচ্চা, তারপর বেরিয়ে গেল।
জানালার কাছ থেকে সরে এলো তিন গোয়েন্দা। মুসাকে দেখে আবার তার কাছে চলে এলো সিমবা।
ব্যানডায় ফিরে বললো কিশোর, এই তাহলে নিরীহ জন্তু-প্রেমিক!
এতো সুন্দর একটা কুকুরের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করে, মুসা বললো। ব্যাটা মানুষ নাকি?
তোমার কথাই ঠিক, কিশোর, রবিন বললো। জজ নির্মল পাণ্ডা লোক ভালো নয়।
কিন্তু কে বিশ্বাস করবে আমাদের কথা? ভুরু নাচালো গোয়েন্দাপ্রধান। প্রমাণ লাগবে। প্রমাণ!
.
২০.
আমার মনে হয় এখানেই আছে গর্তগুলো।
নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা, কন্ট্রোলে হাত। গর্ত চোখে পড়ছে না। তবে অনেক জায়গার ঝোপঝাড় কাটা, নিচে মাটি দেখা যায় না, ডালপাতা আর ঘাস বিছিয়ে আছে। কাছাকাছি রয়েছে বাওবাব গাছের ছোট জঙ্গল। অনেক ওপর থেকে মনে হয়, পেট ফেটে নাড়ীভুড়ি বেরিয়ে থাকা মরা জলহস্তী। মোটা, পেট ফোলা, বাকলও জলহস্তীর চামড়ার মতো দেখতে।