হঠাৎ, ফোয়ারার মতো ছিটকে উঠলো ডোবার পানি, তারপর কাদা, সব শেষে ধোয়া। কানে এলো বিস্ফোরণের শব্দ। বাতাস অস্থির হয়ে যাওয়ায় সাঙ্ঘাতিক দুলে উঠলো বিমান। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ছোট ছোট জানোয়ার, বড়গুলো সুতো-ছেঁড়া গ্যাস-বেলুনের মতো লাফিয়ে উঠলো শূন্যে। মুহূর্ত আগে যে জায়গাটা স্বর্গ ছিলো ওদের জন্যে, সেটা হয়ে গেল নরক। শত শত জীবের গোরস্থান।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। ডিনামাইট!
কিছুই বললো না কিশোর। নীরবে মাথা দোলালো শুধু।
বন থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসতে লাগলো পোচারের দল। জখমী বড়। জানোয়ারগুলোকে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে মারতে শুরু করলো। ছোট ছোট জানোয়ারের মাথা, লেজ, আর দরকারী অঙ্গ কেটে নিতে লাগলো জীবন্ত অবস্থায়ই। রোমহর্ষক দৃশ্য!
উত্তেজনায় প্রথমে প্লেনটা দেখতে পায়নি পোচাররা, খেয়াল করতেই লুকিয়ে পড়ার জন্যে দৌড় দিলো বনের দিকে। তাড়াতাড়ি লজে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলো মুসাকে কিশোর।
ওয়ারডেনকে পাওয়া গেল না, জরুরী কাজে বেরিয়েছেন হিসটোকে নিয়ে। দেরি করলো না কিশোর। যতো দ্রুত পারলো, মাসাইদের নিয়ে ফিরে এলো সেই ডোবাটার ধারে।
কিন্তু, এতো তাড়াতাড়ি করেও কিছু করতে পারলো না। অনেক সময় গেছে। ইতিমধ্যে যা যা নেয়ার, নিয়ে কেটে পড়েছে পোচাররা। ডোবার ধারে জন্তুজানোয়ারের খণ্ডিত, ক্ষত-বিক্ষত লাশ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। পানিতেও অসংখ্য মৃতদেহ। তুলে না ফেললে পচে নষ্ট হবে ডোবার পানি। ওই পানি খেয়ে মড়ক লাগবে জানোয়ারের, পালে পালে মরবে।
কাজে লেগে পড়লো রেঞ্জার আর মাসাইরা। অমানুষিক পরিশ্রম করে সমস্ত মৃতদেহ তুলে আনলো পানি থেকে। ডাঙায় ফেলে রাখলে অসুবিধে নেই। খেয়ে সাফ করে ফেলবে শবভোজী প্রাণীরা। পরদিন সকালে এলে হাড় ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না।
সন্ধ্যার পর লজে ফিরলো দলটা। ভীষণ ক্লান্ত। পেটে খিদে। মেজাজ খারাপ।
.
পরদিন সকালে আবার বিমান নিয়ে বেরোলো গোয়েন্দারা। সরে এলো উত্তরে, চল্লিশ মাইল দূরে…পঞ্চাশ …ষাট…ডানে খানিকটা মোড় নিয়ে পেরিয়ে এলো। আরো দশ মাইল। চোখে পড়লো ধোঁয়া।
কাছে গিয়ে যা দেখলো, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না। বেশ কিছুটা জায়গা ঘিরে শুকনো ঘাসে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। জ্বলছে দাউ দাউ করে। আগুনের বৃত্তের মাঝে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে অনেকগুলো হাতি। বেরোনোর পথ পাচ্ছে না।
পোচাররা রয়েছে নিরাপদ দূরত্বে।
বারো ফুট লম্বা হাতিঘাসের জঙ্গলে নিশ্চিন্তে চরছিলো হাতিগুলো। ভাবতেই পারেনি ওদের ওপর নেমে আসবে নির্মম মৃত্যুর করাল থাবা, জীবন্ত পুড়ে কাবাব হবে। বড় বড় কয়েকটা জানোয়ার মরিয়া হয়ে ছুটলো আগুনের ভেতর দিয়েই। ফলে মৃত্যু হলো আরও নির্মম, আরও যন্ত্রণাদায়ক। আগুনের বাইরে বেরিয়ে অদ্ভুত ভাবে নাচতে শুরু করলো, উন্মাদ হয়ে গেছে যেন। আসলে, পায়ের পাতা পুড়ে গেছে ওগুলোর। মাটিতে পা রাখতে পারছে না। সেই সাথে রয়েছে শরীরের অন্য জায়গা পুড়ে যাওয়ার জ্বালা। মরবে ওগুলো, জানা কথা। বৃত্তের ভেতরে থাকলেই বরং ভালো ছিলো, তাড়াতাড়ি মরতো। পোড়া পায়ের পাতা নিয়ে হাঁটতে পারবে না। খাবার, বিশেষ করে পানির অভাবে কাহিল হবে। অসহায় শিকারে পরিণত হবে হায়েনা, কিংবা হিংস্র পোচারের।
নগ্ন কালো পিশাচগুলোর মাঝে আরেকটা দাড়িওয়ালা পিশাচকে দেখা গেল, গায়ে বুশ জ্যাকেট, পরনে সাফারি ট্রাউজার।
সিলভার! হাত তুলে দেখালো রবিন।
শাঁ করে আরও কাছে বিমান নিয়ে গেল মুসা, নিচে নামলো। শব্দ শুনে ওপর দিকে চেয়ে হাসলো সিলভার, হাত নাড়লো।
শয়তান! দাঁতে দাঁত পিষলো মুসা। ব্যাটা জানে, এখন আমরা কিছু করতে পারবো না। লজে গিয়ে দলবল নিয়ে আসতে আসতে চলে যাবে।
চলো, জলদি ফিরে চললা, কুইক! তাড়া দিলো কিশোর। দেখিই না এসে, কিছু করা যায় কিনা?
কিছুই করা গেল না। চলে গেছে পোচাররা। তাড়াহুড়োয় যা যা নিতে পেরেছে; নিয়ে গেছে। লেজ, পায়ের পাতা, চোখের পাপড়ি, কান। তবে সব চেয়ে দামী জিনিসটাই ফেলে যেতে হয়েছে। দাঁত।
হাতির দাঁত খুলে নেয়া খুবই কঠিন কাজ। হাড় আর মাংসে শক্ত হয়ে লেগে থাকে, যেন সিমেন্টে গাঁথা। কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে কেটে বের করতেও কষ্ট হয়। সহজ উপায় হলো, লাশটা ফেলে রাখা। পচে গলে মাংস খসে গেলে তখন। নেড়েচেড়ে গোড়া থেকে খুলে নেয়া যায় দাঁত। কিন্তু তার জন্যে অনেক সময় দরকার।
.
এরপর থেকে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল সিলভার আর তার খুনীর দল। পাহাড়, জঙ্গল, তৃণভূমির ওপর চক্কর দিয়ে দিয়ে ফিরলো গোয়েন্দারা। কিন্তু কিছুই দেখলো না আর। ঘাসের কুঁড়ে নেই, ট্র্যাপ-লাইন নেই, ডিনামাইট ফাটলো না, আগুন লাগলো না।
পোচিং ছেড়ে দিলো নাকি ব্যাটারা? অবাকই হয়েছে রবিন। ভয় পেলো শেষমেষ!
ইবলিস কি আর শয়তানী ছাড়ে? প্লেন চালাতে চালাতে মন্তব্য করলো মুসা। লুকিয়েছে আরকি। হয়তো কিছুদিনের জন্যে গিয়ে গর্তে ঢুকেছে।
গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলো কিশোর। ঝট করে মাথা ফেরালো। কি বললে? গর্ত? তুড়ি বাজালো। ঠিক বলেছো! নিশ্চয় গর্তেই লুকিয়েছে। কোথায় যেন পড়েছি, হাতি ধরার জন্যে গর্ত খুঁড়ে রাখে, পিগমিরা। ওপরটা ঢেকে রাখে ডালপাতা দিয়ে। না দেখে হাতি গিয়ে পড়ে সেই গর্তে। ওপর থেকে তখন বড় বড় পাথর ছুঁড়ে আর বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে সেটাকে মেরে খেয়ে ফেলে।