চঞ্চল হয়ে ঘুরছে মুসার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। বায়ে হাত তুলে জিজ্ঞেস করলো, ওটা কি?
একবার চেয়েই শাঁ করে প্লেনের মুখ ঘুরিয়ে দিলেন ওয়ারডেন। উড়ে চললেন সেদিকে। তুমি খুব ভালো রেঞ্জার হতে পারবে, মুসা। চোখ আছে। ওটাটাপ লাইন।
ট্র্যাপ-লাইন?
আমি জানি ট্র্যাপ-লাইন কি, রবিন জবাব দিলো। পোচারদের পাতা ফাঁদের। সারি।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে, টমসন বললেন।
দেখে তো বেড়া মনে হচ্ছে, বললো কিশোর।
বেড়া-ই। কাঁটা ঝোপ আর বাঁশ দিয়ে বানায় পোচাররা। পঞ্চাশ গজ থেকে শুরু করে এক মাইল, দুমাইল পর্যন্ত লম্বা করে। এটা মাইল খানেকের কম হবে না। মাঝে ফাঁকগুলো দেখছে না, প্রত্যেকটা ফাঁকে একটা করে ফাঁদ পাতা আছে।
জানোয়ার ধরা পড়ে কি করে? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
ধরো, তুমি একটা জানোয়ার। চরে খেতে খেতে চলে এলে বেড়ার কাছে। ওপাশে যাওয়ার ইচ্ছে হলে কি করবে? এতো লম্বা বেড়া ঘুরে যাবে না নিশ্চয়। উঁচু, লাফিয়ে যাওয়াও কঠিন। তার চেয়ে সহজ কাজটাই করবে, ফাঁক দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করবে। এমন ভাবে বেরোতে চাইবে, যাতে বেড়ার কাটা তোমার গায়ে না লাগে। জায়গা মতো লাগানো আছে তারের ফাঁস। মাথা দিয়ে ঢুকে আটকে যাবে তোমার গলায়। ভয় পেয়ে তখন টানাটানি শুরু করবে, সেটাই স্বাভাবিক। খুলবে না ফাঁস, আরও চেপে বসবে গলায়, চামড়া কেটে মাংসে বসে যাবে। রক্তের গন্ধে ছুটে আসবে মাংসাশী জানোয়ার। জ্যান্তই ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।
খেয়েই যদি ফেললো আমাকে পোচাররা, আর কি পাবে?
পাবে, পাবে। তুমি হাতি হলে ওরা তোমার দাঁত পাবে, পায়ের পাতা পাবে ওয়েইস্ট-পেপার বাস্কেট বানানোর জন্যে। লেজ দিয়ে বানাবে মাছি তাড়ানোর। ঝড়ন। হায়েনারাও ওসব খায় না; ফেলে যায়। গণ্ডার কিংবা অন্য জানোয়ার। হলেও অসুবিধে নেই। পোচারদের জিনিস পোচাররা পেয়েই যায়।
দ্রুত নামছে প্লেন।
কি করবেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
পোচারদের ভয় দেখাবো। বোঝাবো, ওদের আড্ডা দেখে ফেলেছি। অনেক সময় ভয় পেয়ে সরে যায় ওরা, দলে লোক কম থাকলে। বেশি থাকলে অবশ্য। আক্রমণ করে বসে। ভালো করেই জানে ওরা, রেঞ্জার মাত্র হাতে গোণা কয়েকজন আমাদের। তবে আরও যে আসছে, সেকথা এখনও জানে না। ওরা এলে, রাস্তা দিয়ে দল বেধে এসে ধরবো ব্যাটাদের।
আরও নিচে নামলো বিমান। ঠিক বেড়ার ওপর দিয়ে উড়ে গেলেন টমসন। দেখা গেল, প্রায় প্রতিটি ফাঁকেই আটকা পড়েছে জানোয়ার। কোনোটা ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করছে, কোনোটা লুটিয়ে রয়েছে মাটিতে, প্রাণহীন, নিথর। বেড়ার দুপাশে ঘোরাঘুরি করছে, মারামারি কামড়া-কামড়ি করছে শবভোজী প্রাণীর দল- হায়েনা, শিয়াল, বুনো কুকুর, শকুন। প্লেনের শব্দ ছাপিয়ে কানে। আসছে ওদের চিৎকার।
একশো চল্লিশ থেকে শুধু তিরিশ মাইলে গতিবেগ নামিয়ে আনলেন টমসন। গাছের জটলার ভেতরে কয়েকটা খড়ের ছাউনি চোখে পড়লো। পোচারদের অস্থায়ী আস্তানা। মাটির পঞ্চাশ ফুট ওপর দিয়ে সেদিকে উড়ে গেল বিমান।
এতোগুলো আছে ভাবিনি! বিড়বিড় করলেন ওয়ারডেন।
হঠাৎ বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একঝক কালো মানুষ। হাতে তীর ধনুক আর বল্লম। প্লেন সই করে ছুঁড়ে মারলো। যদিও একটাও লাগলো না, বিমানের গায়ে।
বিশেষ কাজের জন্যে তৈরি করা হয়েছে এই প্লেন। সীটের নিচে পায়ের কাছে অ্যালুমিনিয়মের চাঁদরের পরিবর্তে লাগানো হয়েছে শক্ত প্লাস্টিক, যাতে নিচের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যায়। সবই দেখতে পাচ্ছে ওরা।
আবার পোচারদের ওপর দিয়ে উড়ে গেল বিমান। ছুটে এলো আরও এক ঝাঁক তীর। একটা কনুই জানালার বাইরে রেখেছিলেন টমসন, ঝটকা দিয়ে নিয়ে এলেন ভেতরে। ভীষণ চমকে গেছেন। অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। জয়স্টিক চেপে ধরলেন। দ্রুত উঁচু হয়ে গেল বিমানের নাক। সোজা ছুটলো। কিতানি সাফারি লজের দিকে।
.
০৩.
পাশে বসে মুসা দেখতে পেলো না, তার পেছনে বসে রবিনও না। কিন্তু পেছনে বসা কিশোর ঠিকই দেখলো। কালো ছোট একটা তীর বিধে রয়েছে টমসনের বাহুতে। মাংস এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে আছে তীরের চোখা মাথা।
মুসাআ! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। উনি, উনি তীর খেয়েছেন…
পাশে কাত হয়ে তীরটা দেখতে পেলো মুসা। ওরা ভয় পাবে বলে দেখাতে চাননি ওয়ারডেন, লুকিয়ে ফেলেছিলেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন, কিচ্ছু ভেবো না। ঘুমিয়ে পড়ার আগেই ক্যাম্পে পৌঁছে যাবো।
বিষ আছে না? অন্য দুজনের মতোই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে রবিন।
বোধহয়।
তীরের মাথাটা ভালো করে দেখলো মুসা। মারাত্মক বিষাক্ত অ্যাকোক্যানূথেরা গাছের কালো আঠা আঠা রস মাখিয়ে নেয় জংলীরা, শুনেছে সে। তীরের মাথায় সে-রকম কিছু চোখে পড়লো না। কই, বিষ তো নেই। শুধু রক্ত।
ওখানে তো দেখবে না। ও-জায়গায় লাগায় না ওরা।
কেন?
নিজেদের গায়ে লাগার ভয়ে। পিঠের তৃণে তীর নিয়ে ঝোপঝাড়ে চলাফেরা করে, দৌড়ায়। হোঁচট খেয়ে পড়ে। তখন যে-কোনো সময় তীরের খোঁচা লাগতে পারে। যার সঙ্গে থাকে তার গায়েও, যারা সাথে থাকে তাদের গায়েও। নিজেদের বিষে নিজেরাই মরবে।
তাহলে কোথায় লাগায়?
ডাণ্ডায়। তীরের মাথার ঠিক পেছনে।
সর্বনাশ! ওই জায়গাটাই তো ঢুকে আছে আপনার হাতে। বের করে ফেলা। যায় না?