বড় জানোয়ার নেই? কিশোর জানতে চাইলো।
আছে। নিরাপদে রাখার জন্যে গণ্ডারের মতো বড় জানোয়ারও তুলে আনা হয়েছে। তবে মাংসাশী কাউকেই আনা হয়নি। ফলে তৃণভোজীদের বেহেশত হয়ে দাঁড়িয়েছে রুবনড়ডা দ্বীপ।
গা গরম হয়েছে। খাঁচার দরজা খোলা। দীর্ঘ দিন বন্দি থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছে, তাই সুযোগ পেয়ে আর দেরি করলো না মিস্টার ওকাপি। খাঁচা থেকে বেরিয়ে রওনা হয়ে গেল তার সবুজ বেহেশতের দিকে।
আমি কিন্তু ওটার খাবারের কথা বলিনি, আবার বললো মুসা। আমার পেটে এখন ছুঁচোর বেহেশত। সেই যে কবে কোন কালে খেয়েছি মনেই নেই। নাড়িভুড়ি সব হজম। পেটের চামড়াটাই আছে যা শুধু এখন….।
হো হো করে হেসে উঠলেন মিস্টার অরিফিয়ানো ডেল মারটিগা হিসটো। আরে তাই তো! ওকাপিটাকে পেয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম..চলো, চলো!
.
১৭.
গা মুছে, আগুনে হাত-পা সেঁকে গরম হয়ে খাবার খেতে খেতে মাঝরাত পেরোলো।
শোয়ার পর মিনিট খানেকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো মুসা। রবিন দুই মিনিট। কিন্তু কিশোর জেগে রইলো আরও কিছুক্ষণ। ফেরার কথা ভাবছে। সাংঘাতিক ওই হ্রদের পানিতে আবার পনেরো ঘন্টা কাটানোর কথা ভাবতেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে চাইছে তার। তারপর রয়েছে দুই ঘন্টার বিমানযাত্রা। কাল রাতের আগে কিছুতেই টিসাভোয় ফিরতে পারবে না। আর অন্ধকারে সরু ওই ল্যাণ্ডিং স্ট্রিপে প্লেন নামাতে পারবে মুসা?
কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো কিশোর, বলতে পারবে না। ঘুম ভাঙলো ডিম আর মাংস ভাজার চমৎকার সুগন্ধে।
নাস্তার টেবিলে সুখবর দিলেন ওয়ারডেন। বললেন, আমাদের লঞ্চে মুয়ানজায় যেতে পারবে। তাতে মাত্র সাত ঘন্টা লাগবে, অর্ধেকের বেশি সময় বাঁচবে তোমাদের। তবে একটা শর্ত আছে।
কী? আগ্রহে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে কিশোর। ভাবতেই পারেনি, এরকম একটা সুবিধে পাবে। ওই ভেলায় আর পা রাখতে চায় না সে, লঞ্চে করে যাওয়ার জন্যে যে-কোন শর্তে রাজি।
তোমাদের প্লেনে করে টিসাভোয় লিফট দিতে হবে আমাকে, ওয়ারডেন বললেন। টমসনের সঙ্গে কিছু জরুরী আলোচনা আছে। রুবনড়ডায় চারটে গণ্ডার চালান দেয়ার ব্যাপারে।
ফেরার পথেও ঝড় এলো কয়েকবার। তবু, ভেলার তুলনায় লঞ্চে করে যাওয়াটাকে মনে হলো আনন্দভ্রমণ। দুপুরের পর বিমানে চড়লো ওরা। উড়ে চললো রহস্যময় সেরেঙ্গেটি প্লেইন-এর ওপর দিয়ে।
একটা জিনিস দেখাবো তোমাদেরকে, হিসটো বললেন। ওই যে কাটা দাগটা দেখছো, ওর ওপর দিয়ে যাও।
লম্বা গভীর একটা খাত, অনেকটা গিরিখাতের মতো দেখতে। ওটার ওপর দিয়ে উড়ে চললো মুসা।
কি যেন মনে করার চেষ্টা করছে রবিন। বললো, ওলডুভাই গর্জ না ওটা?
অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন ওয়ারডেন। ডক্টর লীকি-র নাম তাহলে শুনেছো?
শুনেছে কিশোরও।
এঁকেবেঁকে গেছে গর্জ, ঠিক ওটার ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে বিমান চালালো মুসা। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ বাঁক ঘুরে অন্যপাশে আসতেই লোকগুলোকে দেখা গেল, ফাটলের তলায় খুঁড়ছে। এঞ্জিনের শব্দে মুখ তুলে তাকালো। হাত নাড়লো, ওয়ারডেনও হাত নেড়ে জবাব দিলেন। দেখতে দেখতে ওদেরকে পেছনে ফেলে এলো বিমান।
মুসা এই গর্জের নাম শোনেনি। জিজ্ঞেস করলো, কি দেখাবেন বলেছিলেন?
দেখলে না? ওয়ারডেন বললেন। মাটি খুঁড়ছে।
সেটা এমন কি স্পেশাল ব্যাপার হলো?
ও, ওলডুভাইয়ের নাম তাহলে শোনননি তুমি? অনেক বছর আগে ডক্টর লীকি বিশ লক্ষ বছরের পুরনো আদিম মানুষের হাড় খুঁজে পেয়েছিলেন ওখানে। সারা পৃথিবীতে সাড়া পড়ে গিয়েছিলো তখন। তার পর থেকেই লেগে আছে বিজ্ঞানীরা। আরও পুরনো ফসিল পাওয়া যায় কিনা খুঁজছে।
অ, আদিম মানুষের ব্যাপারে আগ্রহ নেই মুসার। প্লেন ঘোরানো?
ঘোরাও।
পৃথিবীর বৃহত্তম জ্বালামুখ দেখালেন ছেলেদেরকে ওয়ারডেন। অদ্ভুত নাম মুখটার, নৃগোবরাংগোররা। বহু দিন আগেই মরে গেছে আগ্নেয়গিরিটা। জ্বালামুখে চারপাশের দেয়াল আড়াই হাজার ফুট উঁচু। দেয়ালের গোড়া থেকে শুরু হয়েছে ঘন সবুজের রাজত্ব, ছড়িয়ে গেছে দেড়শো বর্গমাইল। ঘন বনের মাঝে মাঝে বিস্তীর্ণ। তৃণভূমি, কোথাও বা নীল হ্রদ। জন্তুজানোয়ারে বোঝাই এই এলাকা।
অনেক জানোয়ার দেখা যাচ্ছে, কিশোর বললো।
কি কি জানোয়ার? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
চলো, নিজের চোখেই দেখবে, ওয়ারডেন বললেন। নিচে দিয়ে ওড়ো।
সিংহ, হাতি, গণ্ডার অনেক দেখা গেল। তৃণভূমিতে চরছে হাজার হাজার গরু-ছাগল-মোষ। পোষা। মাঝে মাঝে লাঠি হাতে লম্বা মাসাই রাখালদের দেখেই সেটা বোঝা যায়।
জ্বালামুখ পেছনে ফেলে এলো ওরা। সামনে দেখা গেল বিশাল এক হ্রদ, ওটার নাম লেক মনিয়ারা, জানালেন ওয়ারডেন। হ্রদের পানি নীল নয়, কালোও নয়, আশ্চর্য লাল! কাছে আসার পর বোঝা গেল কারণটা। কোটি কোটি ফ্ল্যামিংগো ভাসছে, সাঁতার কাটছে হ্রদের পানিতে এত ঘন হয়ে, দূর থেকে আলাদা করে চেনা যায় না, মনে হয় হ্রদের পানিই বুঝি লাল।
এতো পাখি থাকে কি করে একখানে! বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।
থাকে যেমন, মরেও, ওয়ারডেন বললেন। আগে এতো মরতো না, ইদানীং শুরু হয়েছে। কেন যেন হ্রদের পানি অতিরিক্ত লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এতে লবণ, পাখিগুলোর পায়ে দানা জমে যায়। জমে জমে তিন-চার ইঞ্চি পুরু হয়ে গেলে পা বেজায় ভারি হয়ে যায়, তখন আর উড়তে পারে না ফ্ল্যামিংগো। এই হ্রদে এখন আর ওদের খাবার নেই। অন্য জায়গা থেকে খেয়ে আসতে হয়। উড়তে না পারলে যেতেও পারে না, না খেয়ে মরে।