বিশাল হ্রদ। উত্তর তীর থেকে দক্ষিণ তীরের দূরত্ব আড়াইশো মাইল। ঝড় এলো উত্তর থেকে, পুরো হ্রদটা পাড়ি দিয়ে বয়ে চললো দক্ষিণে। বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ভেলার ওপর। ভিজিয়ে চুপচুপে করে দিচ্ছে যাত্রীদের।
বিমান-যাত্রা নির্বিবাদে সহ্য করেছে মিস্টার ওকাপি, নৌ-যাত্রা মোটেই পছন্দ করতে পারলো না। নানারকম বিচিত্র শব্দ করে প্রতিবাদ জানিয়েই চলেছে। অভ্যাস নেই, ভেলার দুলুনি সইতে পারলো না বেশিক্ষণ, বমি শুরু করলো। পেট থেকে বেরিয়ে এলো সমস্ত পাতা। ভেলার পাটাতনের কাঠামোতে শক্ত করে বাঁধা রয়েছে খাঁচাটা, এতো মচমচ করছে, গোয়েন্দারা আশঙ্কা করছে খুলে, ভেঙে না। চলে যায়।
আর শুধু ঝড়ই নয়, ভিক্টোরিয়ার আরও দুর্নাম আছে। না না, মহারানী ভিক্টোরিয়া নন-যার নামে নাম রাখা হয়েছে এই অগাধ জলরাশির, ভিক্টোরিয়া। হ্রদের কথা হচ্ছে। মাঝে মাঝেই এর নিচে রয়েছে বালির চরা, পানির সমতলের ঠিক নিচে। ওগুলোতে আটকে যাচ্ছে ভেলা। ঢেউ তখন উপকারই করছে। আটকে থাকতে দিচ্ছে না। তবে সব সময় সেটা পারছে না। তখন ব্যাক গীয়ার দিয়ে পিছিয়ে আনতে হচ্ছে ভেলা। কখনও কখনও শুধু এঞ্জিনের জোরে কুলাচ্ছে না, চরায় নেমে ঠেলা লাগাতে হচ্ছে তিন গোয়েন্দাকে। একবার তো ওরকম ঠেলা লাগাতে গিয়ে রবিন পড়লো বিপদে, আরেকটু হলেই ভেসে গিয়েছিলো গভীর পানিতে, তাহলে আর বাঁচতো না। সবে চরায় নেমেছে ওরা, ছয় ফুট উঁচু এক ঢেউ এসে ধাক্কা দিয়ে চিত করে ফেলে দিলো ওকে। ভাগ্যিস মুসার হাত ধরে রেখেছিলো। সে আর কিশোর মিলে টেনে-হিঁচড়ে সোজা করলো রবিনকে।
বিপদ আরও আছে। কুমির আর জলহস্তী। অগুনতি। কিলবিল করছে যেন হ্রদের পানিতে, বিশেষ করে ইয়া বড় বড় কুমির। মাঝে মাঝে ঘ্যাঁশশ করে ঘষা লাগায় ভেলার নিচে, যেন গাছের গুঁড়ি একেকটা। উল্টে দেয়ার চেষ্টা করে। না পারলে পাশে ভেসে ওঠে। অসতর্ক আরোহী পেলে লেজের বাড়ি মেরে ফেলে দিতে পানিতে, তারপর, গাঁপ!
জলহস্তীর ভয় আপাতত তেমন নেই। ঝড়ের দাপটে পানিতে থাকতে পারছে না ওরা, গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে হ্রদের মাঝে মাঝে জেগে ওঠা দ্বীপে। ওরকম একটা দ্বীপের কিনার দিয়ে চলার সময় ধুড়ুম করে হঠাৎ কিসের সঙ্গে যেন বাড়ি লাগলো। ভেলার। মুহূর্ত পরেই দেখা গেল, এক পাশ ঠেলে উঠছে ওপর দিকে। নিচে থেকে কিসে যেন ঠেলে কাত করে যাত্রীদের ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। সুবিধে করতে না পেরে বেরিয়ে এলো ওটা। বিরাট এক মদ্দা হিপো, মানে জলহস্তী। বিরাট হাঁ করে মোটা মোটা দাঁত দেখিয়ে ভেঙচি কাটলো, তারপর বন্ধ করলো। এমন বিকট শব্দ হলো, মনে হলো সিন্দুকের ডালা পড়েছে। একটা বলে সুবিধে করতে পারেনি, ওটার একটা সহকারী থাকলেই দিয়েছিলো ভেলীর সর্বনাশ করে।
দিনটা কাটলো কোনোমতে, এলো অন্ধকার রাত। বুনো হ্রদে উত্তাল ঝড়ের মাঝে শুরু হলো যেন ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়েছে তিন গোয়েন্দা, এই সময়, বহু যুগ পরে যেন চোখে পড়লো দূরে ক্ষীণ আলো, সেই সঙ্গে জাগলো। আশার আলো। রুবনডো আইল্যাণ্ড! ক্ষণিকের জন্যে দেখা গেল আলোটা, তারপরেই মুষলধারে বৃষ্টি আর কুয়াশার মাঝে হারিয়ে গেল। শুধু আন্দাজের ওপর ভেলা চালাচ্ছে চালক। এই হ্রদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট পরিচয় না থাকলে অনেক আগেই হাল ছেড়ে দিতো।
কিছুক্ষণ পর আবার দেখা গেল আলো।ঠিক সময়মতো। আরেকটু হলেই পাশ দিয়ে সরে চলে গিয়েছিলো ভেলা। এমনিতেই অনেকখানি বিপথে সরে গেছে।
যা-ই হোক, দুর্গম নৌ-যাত্রার অবসান ঘটলো অবশেষে। দ্বীপের কিনারে ছোট একটা খাড়িতে ঢুকলো ভেলা। বাতাস তেমন ঢুকতে পারে না এখানে, ফলে ঢেউও খোলা হ্রদের তুলনায় অনেক কম। চেঁচিয়ে ডাকলো চালক।
সাড়া এলো তীর থেকে।
কাছে এসে দাঁড়ালেন এখানকার ওয়ারডেন। নাম জানালেন, অরিফিয়ানো ডেল মারটিগা হিসটো। হেসে বললেন, খুব লম্বা নাম, না? তোমাদের এতো কষ্ট। করতে হবে না। শুধু অরিফ বললেই চলবে, খাঁচাটা নামাতে সাহায্য করলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, কি নিয়ে এসেছো?
একটা ওকাপি।
সেটা বুঝতেই পারছি। মিস্টার, না মিসেস?
প্রশ্নটা অদ্ভুত মনে হলো তিন গোয়েন্দার কাছে। পুরুষ না মাদী, তাতে কি এসে যায়?
মিস্টার,জবাব দিলো কিশোর।
গুড। এই দ্বীপে আর একটা মাত্র ওকাপি আছে, মিসেস। বংশবৃদ্ধির চান্স হলো। খুব দুর্লভ জানোয়ার, ওকাপির কথা বলছি। দাঁড়াও, আসছি।
দৌড়ে ছোট কেবিনে গিয়ে ঢুকলেন ওয়ারডেন। ফিরে এলেন একটা বড় তোয়ালে নিয়ে। ভিজে একেবারে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে গোয়েন্দাদের, ওরা ভাবলো ওদের জন্যে এনেছেন। তা নয়। খাঁচার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। মোলায়েম হাতে ওকাপিটার গা মুছতে শুরু করলেন।
একেবারে জামাই আদর। ওকাপির গায়ের প্রতিটি ইঞ্চি যত্ন করে মুছলেন মিস্টার হিসটো, ওটার ঠাণ্ডা শরীর গরম করলেন। ব্যস, হয়েছে, আর ঠাণ্ডা লাগার ভয় নেই।
খাওয়ার কি ব্যবস্থা? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
আছে। বনের মধ্যে ঢুকলেই পেয়ে যাবে। যেদিকে ফিরবে সেদিকেই খাবার। পানির তো অভাবই নেই…।
তাহলে কি এখন শুধু ছেড়ে দিলেই হবে? বাধা দিয়ে বললো রবিন।
সেটাই উচিত। নিজের দায়িত্ব নিজেই নেয়া ভালো। এই দ্বীপে ওর কোনো শত্রু নেই। সিংহ, চিতাবাঘ, পোচার, কিচ্ছু না।