তারপর এলো হাতি। বিরাট বিরাট দানব একেকটা। দল বেঁধে নেমে গেল পানিতে। শুড় দিয়ে নিজের গায়ে, একে-অন্যকে পানি ছিটালো কিছুক্ষণ, ধুয়ে গেল ধূসর-কালো চামড়ায় লেগে থাকা ধুলো-ময়লা। পানি থেকে উঠে এলো ওরা। গণ্ডারের পায়ের চাপে ছোট ঘোট গর্ত হয়ে গেছে নরম পারে, পানি ঠেলে উঠছে। ওগুলোতে শুড়ের ডগা ডুবিয়ে দিলো হাতিরা, লবণ সংগ্রহ করে মুখে পাচার করতে লাগলো। মাঝে মাঝে কুতকুতে চোখ মেলে তাকাচ্ছে ফ্লাডলাইটের দিকে। ওই তাকানো পর্যন্তই, চাঁদ কিংবা সুরুজ মনে করেই হয়তো গুরুত্ব দিচ্ছে না। কি ভাবছে ওরাই জানে।
গণ্ডারের মতো বদমেজাজী নয় হাতি। অন্তত নিজেদের মধ্যে অযথা লড়াই করছে না। শান্তভাবে লবণ খাচ্ছে। কোনো শিশু কিংবা অল্পবয়েসী হাতি এসে বড়টার গর্তে শুড় ডোবানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঔড় তুলে নিয়ে ওটাকে জায়গা দিয়ে দিচ্ছে বড়টা। নিজে খুঁজে নিচ্ছে অন্য গর্ত।
ভয়ঙ্কর চেহারার পাঁচটা মোষ বেরিয়ে এলো। গণ্ডারের চেয়েও বদমেজাজী। এসেই জায়গার দখল নিয়ে লেগে গেল নিজেরা, সেই ক্ষোভ অন্যের ওপর গড়াতে দেরি হলো না। গণ্ডার আর মোষে লড়াই বেধে গেল দেখতে দেখতে। শিংয়ের। সঙ্গে শিংয়ের ঠোকাঠুকি, রাগতঃ, ঘোঁৎ ঘোৎ, খুরের দাপাদাপি চললো কয়েক মিনিট। গায়ে পড়ে হাতিদের সঙ্গে গিয়ে লাগলো দুই জাতের বদমেজাজী। কতো আর সওয়া যায়? রাগলো হাতিরাও। মোষগুলোকে পিটুনি লাগালো প্রথমে। ওগুলো পিছু হটে যেতেই গণ্ডারের পিঠে মোটা চাবুকের মতো আছড়ে পড়তে লাগলো শুড়। কিছুক্ষণ গাঁইগুই করে সরে যেতে বাধ্য হলো ওরাও। এই বিরক্তিকর যুদ্ধের পর আর খাওয়া, খেলা কোনোটাই জমে না। হাতিগুলোও চলে গেল।
বন থেকে বেরিয়ে এসে পানি খেতে নামলো একটা জিরাফ। সামনের পা। অনেক বেশি লম্বা, প্রকৃতিই গড়েছে ওদের ওরকম করে, গলা তুলে উঁচু ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে খাওয়ার সুবিধের জন্যে। একসাথে দুটো সুবিধে তো আর দেয়া যায় না, গলা নামিয়ে পানি খেতে তাই অসুবিধে হয় জিরাফের। সামনের দুই পা অনেক ছড়িয়ে ফাঁক করে মুখ দিয়ে পানির নাগাল পেতে হয়।
জানোয়ারের ভিড় লেগেছে হ্রদের তীরে। অনেক ধরনের হরিণ এসেছে : ইমপালা, টমি, গ্র্যান্ট, কুড়ু, ওয়াটারবাক, ক্লিপম্প্রিঙ্গার।
মুসার গায়ে কনুই দিয়ে আলতো গুতো দিলো রবিন, নীরবে হাত তুলে দেখালো একদিকে।
বনের কিনারে একটা গাছের ডালে জমায়েত হয়েছে অনেকগুলো কোলোবাস বানর। সতর্ক চোখে আলোর উৎসের দিকে তাকাচ্ছে। দ্বিধা করলো কিছুক্ষণ, তারপর দোল খেয়ে মাটিতে নামলো দলপতি। টুপটাপ করে লাফিয়ে পড়তে লাগলো অন্যগুলো। দল বেঁধে এগোলো পানির দিকে। প্রাকৃতিক পরিবেশে অপূর্ব সুন্দর লাগছে প্রাণীগুলোকে। তীব্র আলোয় চকচক করছে কালো-সাদা রোম। মহিলারা যে পছন্দ করে, খামোকা নয়। আর তাদের পছন্দের কারণে প্রতি মাসে জীবন দিতে হচ্ছে দশ হাজার করে কোলোবাসকে।
দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো মুসা। মিস্টার কোলোবাসও কি আছে দলে? দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। হাঙ্গারের কাছ থেকে একটা বিনকিউলার চেয়ে নিলো সে।
হ্যাঁ, আছে। গলার ওই ফাসের দাগ কোনো দিন মুছবার নয়। নতুন বন্ধুদের সঙ্গে খুব সুখেই আছে মনে হয় বানরটা। বুকের কোথায় যেন খচ করে উঠলো মুসার। একেই কি বলে জেলাসি? লজ্জিত হলো মনে মনে। তার কাছে থাকলে মিস্টার কোলোবাস অনেক আদর পেতো, সন্দেহ নেই, কিন্তু ওই স্বাধীনতা কি পেতো? হোক না একটা বানর, ওটার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার কি অধিকার আছে তার? তাকে যদি কেউ খাঁচায় পুরে ভালো ভালো খাবার দিতো…আর ভাবতে পারলো না মুসা।
অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকলো মেহমানরা। তারপর একে একে উঠে চলে গেল যার যার ঘরে। তিন গোয়েন্দাও ঘুমাতে চললো।
১৬.
ফ্যানটাসটিক আইডিয়া! সকালে নাস্তা খেতে খেতে হাঙ্গারকে বললো কিশোর। হ্রদের ধারে গাছের ওপর হোটেল বানানো!
একমত হলো পথপ্রদর্শক। হ্যাঁ, এর জন্যে কল্পনাশক্তি দরকার। বেরিয়েছিলো এক ভদ্রমহিলার মাথা থেকে। তাঁর নাম লেডি বেটি ওয়াকার। অনেক দিন আগে ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে এসেছিলেন। বিখ্যাত ক্লাসিক সুইস। ফ্যামিলি রবিনসনের খুব ভক্ত ছিলেন তিনি। সেই বই পড়া থাকায়ই গাছের ওপর বাড়ি বানানোর আইডিয়া ঢোকে তাঁর মাথায়। বেড়াতে এসে বন্ধুদের বলেছিলেন সেকথা। শুনে তো হেসেই খুন ওরা। কিন্তু লেডি ওয়াকার দমলেন না। বানিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
একটা কাজের কাজই করেছেন তিনি, রবিন বললো। তার সৌজন্যেই কাল রাতে ওই চমৎকার দৃশ্য দেখার সুযোগ পেলাম।
তা তো পেলাম, শূন্য প্লেটটা ঠেলে সরালো মুসা। আমি ভাবছি আজকের কথা। সামনে খুব কঠিন কাজ পড়ে আছে।
প্লেনে ফিরে দেখা গেল, খাঁচার মধ্যে আরামে পাতার নাস্তা চিবুচ্ছে মিস্টার ওকাপি। হাজারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিমানে চড়লো তিন গোয়েন্দা।
সিংহের জন্যে বিখ্যাত সেরেঙ্গেটি প্লেইন-এর ওপর দিয়ে মুয়ানজার দিকে, উড়ে চলেছে বিমান। দুই ঘন্টা পর নামলো ভিক্টোরিয়া হ্রদের দক্ষিণ পারে।
বন্দরে এসে ভালো কোনো বোট পেলো না তিন গোয়েন্দা। অনেক চেষ্টার পর একটা নৌকা মিললো, নড়বড়ে ভেলাই বলা চলে ওটাকে। এককালে নদীতে ফেরী পারাপার করতো। একটিমাত্র আউটবোর্ড মোটর, বহু পুরনো, প্রচণ্ড আওয়াজ। অগত্যা ওটা নিয়েই রুবনডো আইল্যাণ্ডে চললো ওরা। ওয়ারডেন টমসন বলে দিয়েছেন, যেতে পনেরো ঘন্টা লাগবে, আর ওই সময়ে ঝড় আসবে অন্তত পাঁচবার। ভুল করেছেন তিনি। একটা ঝড়ই এলো, কিন্তু টিকে রইলো পনেরো ঘন্টারও বেশি।