অনেক বিখ্যাত লোক রাত কাটিয়ে গেছেন ওই হোটেলে, রবিন বললো।
জানি, বললো কিশোর। রানী এলিজাবেথও নাকি এসেছিলেন।
তখনও তিনি রানী হননি, শাহজাদী ছিলেন। ওই হোটেলে থাকার সময়ই রাতে খবর এলো, তার বাবা মারা গেছেন, সিংহাসনে বসতে হবে এবার তাকে।
রাজা ফিলিপ আসেননি? মুসা প্রশ্ন করলো।
কয়েকবার, জবাব দিলো হাঙ্গার। আফ্রিকান ওয়াইল্ড লাইফ রক্ষায় তার দান অপরিসীম। অনেক কিছু করেছেন তিনি এখানকার বুনো জানোয়ারের জন্যে।…এসো, ওপরে উঠি।
সিঁড়ির নিচে জালে ঘেরা একটা ছোট জায়গায় গিয়ে ঢুকলো ওরা। অনেকটা টেলিফোন বুদের মতো, তবে ছাত নেই। সিঁড়ির নিচের ধাপটা বারো ফুট ওপরে। অবাক হয়ে ভাবলো তিন গোয়েন্দা, ওখানে উঠবে কি করে। একটা বোতাম টিপলো হাজার। হড়হড় করে নেমে এলো সিঁড়িটা, ঘেরা জায়গার ভেতরে। তাতে তিন গোয়েন্দাকে তুলে দিয়ে হাজারও উঠলো। আরেকটা বোতাম টিপতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওপরে উঠতে লাগলো সিঁড়ি, বন্দর ছাড়ার আগে জাহাজের সিঁড়ি যেভাবে টেনে তুলে নেয়া হয় অনেকটা তেমনি ভাবে।
এই ব্যবস্থা কেন? জানতে চাইলো রবিন। জানোয়ারের ভয়ে?
হ্যাঁ, হাঙ্গার বললো। বড় জানোয়ার এসে ভেঙে ফেলতে পারে। কিংবা ওপরে উঠে গিয়ে মহা অনর্থ ঘটাতে পারে চিতাবাঘ। সেজন্যেই ওগুলোর নাগালের বাইরে তুলে রাখা হয় সিঁড়ি।
দুর্গের ড্রব্রিজের মতো, বিড়বিড় করলো কিশোর।
গাছের মাথার সুরক্ষিত দুর্গের দোরগোড়ায় পৌঁছলো ওরা।
ভেতরে ঢুকে ম্যানেজারের সঙ্গে তিন গোয়েন্দার পরিচয় করিয়ে দিলো হাঙ্গার।
হোটেল হিসেবে খুবই হোট ট্রীটপস মাত্র বারোজন মেম্বারের জায়গা হয়, কিন্তু গাছের মাথার বাড়ি হিসেবে আবার অনেক বড়। ডাল দুললেই বাড়ি দোলে। এমনকি কোনো লোক যদি জোরে হাঁটে, কিংবা আস্তেও লাফ দেয়, কেঁপে ওঠে গোটা বাড়ি।
ছেলেদের ঘরের বাইরে একটা ব্যালকনি। ওখানে বসে হ্রদের একপাশ স্পষ্ট দেখা যায়।ট্রীটপসের ছাতে যাওয়ার সিঁড়িও আছে। ওখান থেকে নিচে চারপাশেই। নজর চলে।
.
১৫.
এখানে যেন শুধুই ফিসফিসানী। নোটিশ লেখা রয়েছে, জোরালো শব্দ করে যাতে জন্তুজানোয়ারকে বিরক্ত না করা হয়। ফলে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে না কেউ। মেহমানরা ফিসফিস করছে, ফিসফিস করছে হোটেলের পরিদর্শক, চাকর-বাকর সবাই। সবার পায়ে রবার সোলের জুতো। এটা নিয়ম। মেহমানদের কারও ওরকম জুতো না থাকলে হোটেল থেকে কিনে নিয়ে পরতে হবে, চামড়ার জুতো পরে মচমচ করা চলবে না।
একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, মুসা বললো। আমাদের কথা নাহয় না শুনলো, গন্ধ তো পাবে? ওগুলোর কাছ থেকে মাত্র পঞ্চাশ ফুট ওপরে রয়েছি আমরা।
পঞ্চাশ ফুট কেন, সিকি মাইল দূরে থাকলেও পেতো, জবাব দিলো হাঙ্গার। যদি নিচে থাকতাম আমরা, ওদের নাকের লেভেলে। কিন্তু এতো ওপরে রয়েছি, আমাদের গায়ের গন্ধ নিচে নামতে পারছে না, তার আগেই সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস, ওদের মাথার অনেক ওপর দিয়ে। আমরা আছি এটা বুঝতে পারবে শুধু শব্দ করলেই। সে-কারণে সর্দি লাগা কোনো লোকের এখানে আসা বারণ। একটা কাশি শুনলেই চোখের পলকে জঙ্গলে পালাবে সমস্ত জানোয়ার। পরে ফিরে আসবে। অবশ্য। জায়গাটাকে ওরা ভালোবাসে। হ্রদের ধারে কাদামাটিতে লবণের ছড়াছড়ি। পানি তো বটেই, লবণ ও খেতে আসে।
ডাইনিং রুমের লম্বা টেবিলে চমৎকার ডিনার দেয়া হলো। পেট পুরে খেলো সবাই। তারপর নিঃশব্দে ব্যালকনিতে চলে এলো বারোজন মেহমান। তাকিয়ে রইলো নিচের দিকে। পরনে ভারি পোশাক ওদের, ঠাণ্ডা যাতে না লাগে। কেউ কেউ তো বিছানা থেকে কম্বল এনে গায়ে জড়িয়েছে। সমুদ্র সমতলের সাত হাজার ফুট ওপরে রয়েছে, কনকনে শীত এখানে।
রাতের অন্ধকারে ঢাকা পড়লো নিচের দৃশ্য। জ্বলে উঠলো শক্তিশালী ফ্লাডলাইট। হ্রদের পাড়ের অনেকখানি জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো আলো। জানোয়ারেরা এই আলোতে অভ্যস্ত, বোঝা গেল। দুটো শুয়োর; একটা ওয়াটহগ, আর একটা ওয়াটারবাক এসে ইতিমধ্যেই হাজির হয়েছে। আলোর দিকে চোখ তুলে তাকালো একবার। অবাক হলো না তেমন। হয়তো ভাবছে, এটাও খুদে কোনো সূর্য। আলোর জন্যে ব্যালকনিটা দেখতে পেলো না, ফলে ঘাবড়ালো না, লবণ খোঁটায় মন দিলো।
চারটে গণ্ডার বেরিয়ে এলো বন থেকে। এসেই লবণাক্ত কাদা চাটতে শুরু করলো। একটু পরেই লেগে গেল ঝগড়া, সব চেয়ে ভালো জায়গাটার দখল নিয়ে। এ-ওকে ধাক্কা মারছে, রেগে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে শুয়োরের মতো, তবে শুয়োরের। চেয়ে ওদের গলার জোর অনেক বেশি আকারটাও তো দেখতে হবে। কানগুলো। বার বার এদিক-ওদিক নাড়ছে, অনেকটা রাডারের মতো, সন্দেহজনক সামান্যতম শব্দ পেলেই ছুটে পালাবে।
কাশির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে হোটেল কর্তৃপক্ষ, কিন্তু ভোলা জায়গায় মশার বিরুদ্ধে কি করবে? মিনি জেট প্লেনের মতো বোঁ বোঁ করে সোজা এসে কিশোরের নাক দিয়ে ঢুকে পড়লো একটা। আর কি থাকা যায়। গায়ের জোরে হ্যাচচো করে উঠলো সে।
দুপদাপ করে ছুটে পালালো জানোয়ারের দল। নিমেষে হ্রদের তীর খালি।
তবে, বেশিক্ষণ লাগলো না, পায়ে পায়ে আবার ফিরে আসতে শুরু করলো। গোটা চারেক গণ্ডারও এলো আবার, বোধহয় আগেরগুলোই কিংবা অন্য জানোয়ার। একটার পেছনে আরেকটা সারি দিয়ে এলো, নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করছে, কয়লার রেল-এঞ্জিনের মতো।