হাঁটতে হবে এবার, জানালো হাঙ্গার। বেশি না, এই কোয়ার্টার মাইল।
মৌন হয়ে থাকা বিশাল দানবগুলোর ফাঁক দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে খুব সরু পায়েচলা পথ। ধীরে ধীরে উত্তেজিত হয়ে উঠছে বানরটা। বড় বড় গাছগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে যেন তাকে, খাসা বাড়ি হবে এখানে। মাউন্ট কেনিয়ার তুষার ছুঁয়ে নেমে আসা বাতাস কনকনে ঠাণ্ডা। কোলোবাসের উপযুক্ত জায়গা। এটা।
মই কিসের ওটা? গাছের গায়ে বড় বড় পেরেক দিয়ে আটকে রাখা লম্বা মই দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর। আরে, আরও আছে দেখছি।
এখুনি বুঝতে পারবে, গম্ভীর হয়ে গেছে হাঙ্গার। ওই মই বেয়ে ওঠো, জলদি!
কেন? রবিনের প্রশ্ন।
আহ, কথা বাড়িও না! যা বলছি করো।
আগে আগে উঠতে শুরু করলো মুসা, গলা জড়িয়ে ধরে রইলো বানরটা। তার পেছনে রবিন, কিশোর, সবার শেষে হাঙ্গার। বনের ভেতরে প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে, ভেঙেচুরে মারিয়ে একাকার করে ফেলছে যেন গাছপালা। শোনা গেল হাতির গুরুগম্ভীর চিৎকার। হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো গাছের আড়াল থেকে, পথের ওপরে।
আরও ওপরে ওঠো! চেঁচিয়ে বললো হাঙ্গার।
শেষ মাথায় উঠে গেল মুসা। মইটা অনেক লম্বা। সবার নিচে থাকা হাঙ্গারের পা-ও শুড় বাড়িয়ে ধরতে পারবে না হাতি। সে চেষ্টা অবশ্য করলোও না ওরা।
বুঝতে পারলে তো এখন, কেন এই মই? বললো হাঙ্গার। জন্তুজানোয়ারে বোঝাই এই বন। যখন তখন বেরিয়ে আসে পথের ওপর। এখানে একটা কথা প্রচলিত আছেঃ গণ্ডার আর মোষ হলে আট ফুট, হাতি হলে আঠারো ফুট। তার মানে কোন জানোয়ার আসছে সেটা বুঝে নিয়ে তার নাগালের বাইরে যেতে হলে ততোখানি উঠতে হবে।
পার্কের মধ্যেও বুনো-হয়ে আছে নাকি? মানুষের ক্ষতি করে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।
পার্ক কি আর পোষ মানানোর জন্যে? নিরাপদে রাখার জন্যে। বুনোই তো থাকবে। তবে মানুষ দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে যায় ওগুলোর, না খোঁচালে সহজে ক্ষতি করে না। তবুও, ঝুঁকি না নেয়াই উচিত। হাতি-গণ্ডার-মোষের মেজাজ-মর্জি বোঝা মুশকিল। আর আহত হলে তো সর্বনাশ। দেখা মাত্র মারতে আসবে।
এখন কি করবো?
জাস্ট ওয়েইট। অপেক্ষা।
কতক্ষণ?
পাঁচ মিনিট হতে পারে, পাঁচ ঘন্টাও লাগতে পারে। আমরা তাড়াহুড়ো করলে কিছু হবে না। ওদের যখন ইচ্ছে যাবে।
অপেক্ষা করার জায়গাটা সুবিধের নয়, ভাবলো মুসা। মই আঁকড়ে ধরে থাকা, তার ওপর কাঁধে রয়েছে এক বানর।
বিন্দুমাত্র তাড়া নেই হাতিগুলোর। অলস ভঙ্গিতে ডালপাতা ভেঙে ভেঙে খাচ্ছে। চারা গাছ ওপড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে ওপরে তাকিয়ে দেখছে, মানুষগুলো আগের জায়গাতেই আছে কিনা।
অস্থির হয়ে উঠছে মিস্টার কোলোবাস। বার বার ওপরে তাকাচ্ছে। মুসার মনে হলো, ওপরে জীবন্ত কিছু আছে, ওটাই বানরটার আকর্ষণ। সে-ও তাকালো। প্রথমে কিছু দেখলো না, তারপর মগডালে পাতার আড়ালে মৃদু নড়াচড়া চোখে। পড়লো।
মুখটা দেখতে পেলো আরও পরে। কপাল-কান-মাথা সব কালো; কপালের নিচটা, গাল, থুতনি সাদা। নিশ্চয় কোলোবাস। আরেকটু মুখ বের করলো ওপরের বানরটা। কিচির-মিচির করে ডাকলো মিস্টার কোলোবাসকে, ওটার কাছে যাওয়ার জন্যে।
অন্যেরাও লক্ষ্য করেছে ব্যাপারটা।
দেবো নাকি ছেড়ে? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
দাও, হাঙ্গার বললো.। কোলোবাসের জন্যে ভালো জায়গা। তাছাড়া মিস ভাকছেন। মিস্টারের অনাদর হবে বলে মনে হয় না।
মিস, না মিসেস? দাঁত বের করে হাসলো মুসা।
এখন তো মিসই মনে হচ্ছে। মিস্টার গেলে পরে মিসেস হবেন আরকি।
বানরটাকে ভালোবেসে ফেলেছে মুসা। ছাড়তে কষ্টই হলো। তবু, তার কাছে থাকার চেয়ে বনে অনেক ভালো থাকবে ভেবে মন শক্ত করলো। ওটার গায়ে হাত রেখে তারপর ডালে চাপড় মেরে দেখিয়ে বললো, যা, যা।
লাফ দিয়ে গিয়ে ডালটায় বসলো মিস্টার কোলোবাস। ফিরে তাকালো মুসার দিকে তাকিয়ে রইলো চিন্তিত চোখে। মনস্থির করে নিয়ে ঘুরলো। লাফিয়ে ধরে ফেললো ওপরের আরেকটা ডাল। সে-ডাল থেকে আরেক ডাল. করে করে উঠে গেল ওপরে। পাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আরও কয়েকটা বানর। আশ্চর্য দক্ষতায় লুকিয়ে ছিলো এতোক্ষণ। মেহমানকে স্বাগত জানাতেই যেন সম্মিলিত কিচির-মিচির জুড়ে দিলো। যাক, মিস্টার কোলোবাসকে সাদরেই গ্রহণ করেছে, তবে হয়তো মিস কোলোবাসের বদান্যতায়।
আরে, কেঁদে ফেলছো কেন? মুসার দিকে চেয়ে বললো হাঙ্গার। মন খারাপ করো না। আবার দেখতে পাবে ওকে।ট্রীটপস লেকে রোজ রাতে পানি খেতে যায় কোলোবাসেরা।
রওনা হয়ে গেল হাতিরা। বনের ভেতর মিলিয়ে গেল,ওদের শব্দ। মই থেকে নেমে আবার ট্রীটপসের দিকে চললো চারজনে।
গাছের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়লো ট্রীটপস। অদ্ভুত দৃশ্য! মনে হচ্ছে যেন শূন্যে ভেসে রয়েছে একটা বড় বাড়ি। মাটি থেকে পঞ্চাশ ফুট ওপরে, দুলছে। বাতাসে গাছের ডাল দোলে, সেই সাথে বাড়িটাও। আরও কাছে এগিয়ে দেখা গেল ওটার ভিত-ডালপালা। দরজা থেকে নেমে এসেছে বিচিত্র কাঠের সিঁড়ি।
একটা হ্রদের দিকে মুখ করে আছে বাড়িটা। ছোট হ্রদ, তীরে ঘন বন। এই বিখ্যাত জায়গাটার কথা অনেক শুনেছে তিন গোয়েন্দা। রাতের বেলা বন থেকে বেরিয়ে হ্রদে পানি খেতে আসে অনেক রকম জানোয়ার। আরও একটা আকর্ষণ আছে ওগুলোর, হ্রদের আশেপাশে লবণের গর্ত। হোটেলের ব্যালকনি থেকে হ্রদ আর গর্তগুলো পরিষ্কার দেখা যায়। চুপ করে থাকলে, কোনো রকম শব্দ না করলে নিচের অনেক আশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায় ওখানে বসে।