ভেলায় করে আমাজানের জঙ্গল থেকে জাগুয়ার আর অ্যানাকোপ্তা নিয়ে এলাম, মুসা বললো। আর এটা তো কোনো ব্যাপারই না। নিশ্চয় পারবো। কতো আর সময় লাগবে? ফেরিতে করে বড় জোর এক-দুই ঘন্টা।
হাসলেন টমসন। দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্রদ, লেক ভিক্টোরিয়া। দ্বীপে যেতে কমপক্ষে পনেরো ঘন্টা লাগবে। আর ওই পনেরো ঘন্টায় অন্তত পাঁচটা ঝড়ের কবলে যদি না পড়েছে, তো নাম বদলে ফেলবো আমার। ভেবে দেখো, ঝুঁকিটা নেবে?
কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিলেন আমাদের, কিশোর বললো। এরপর আর না গিয়ে পারা যায় না। হ্রদটা দেখতেই হবে।
হ্যাঁ, দেখতেই হবে, সুর মেলালো রবিন।
বেশ, চলো অফিসে, বলে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলেন ওয়ারডেন।
.
১৪.
এই যে, অ্যাবারডেয়ার, টেবিলে বিছানো পূর্ব আফ্রিকার ম্যাপের এক জায়গায়, আঙুল রাখলেন টমসন। এই হলো নাইরোবি, এর উত্তরে। নাইয়েরিতে নামবে তোমরা, তারপর গরুর গাড়িতে করে যাবে ট্রীটপস-এ। নাম শুনেছো?
মাথা ঝাঁকালো বইয়ের পোকা রবিন। নিশ্চয়ই। দানবীয় ক্যাপ চেস্টনাট গাছের ওপরে তৈরি হোটেলটার কথা বলছেন তো?
ওখানকার বেশির ভাগ গাছই দানবীয়। কোলোবাসের খুব পছন্দ। রাতে গাছের ওপরের বাড়িতে কাটাবে। পরদিন প্লেন নিয়ে চলে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমে, তিনশো মাইল দূরের মুয়ানজায়। এই যে, এখানে। পাশে এটা লেক ভিক্টোরিয়া। আর এই হলো রুবনডো দ্বীপ, সরাসরি গেলে একশো মাইল।
কখন রওনা হচ্ছি আমরা? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
এখন বেরোলে রাতের আগেই পৌঁছে যাবে ট্রীটপসে।
চলো, যাই, বন্ধুদের বললো কিশোর।
যাত্রীদের জায়গা করার জন্যে পেছনের দুটো সীট খুলে ফেলতে হলো। বাঁশের খাঁচায় ভরে, পাঁচজন লোকে বয়ে নিয়ে গিয়ে মিস্টার ওকাপিকে প্লেনে তুললো।
বেশি ভারি হয়ে যাবে না? মুসা জানতে চাইলো।
না, বললেন ওয়ারডেন। আড়াইশো হর্সপাওয়ারের এঞ্জিন। আড়াই টন ওজন তুলতে পারে। ওকাপিটা কোয়ার্টার টনের বেশি হবে না।
তিন কোটি বছরের বনেদি জীবৃটা জীবনে কখনও বিমানে ওঠেনি, মোটেও পছন্দ করতে পারলো না ওই বদ্ধ পরিবেশ। উদ্বিগ্ন ঘোড়ার মতো চি-চি করে প্রতিবাদ জানাতে লাগলো। শক্ত মাথা দিয়ে জোরে জোরে বাড়ি মারলো খাঁচার বেড়ায়। গোয়েন্দাদের ভয় হলো, ভেঙে না যায়।
কচি পাতাওয়ালা একটা গাছের ডাল ভেঙে এনে খাঁচার ওপরে রেখে দিলেন। টমসন, আড়াআড়ি বাধা বাঁশের কঞ্চির ফাঁক দিয়ে পাতাগুলো ঝুলে রইলো ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে বারো ইঞ্চি লম্বা ফিতের মতো জিভটা বের করে পাতায় পেঁচিয়ে শক্ত দাঁতের আওতায় টেনে নিয়ে এলো মিস্টার ওকাপি। যতোক্ষণ ওই লোভনীয় খাবার মাথার ওপর থাকবে, কোনো গোলমাল করবে না সে আর।
শান্ত স্বভাবের মিস্টার কোলোবাসের জন্যে খাঁচার, প্রয়োজন হলো না। বুদ্ধিমান জীব, ফলে কৌতূহল তার জন্মগত। প্রথমেই কন্ট্রোল প্যানেলের। যন্ত্রপাতিগুলো ধরে ধরে দেখলো, তারপর চড়ে বসলো মুসার কাঁধে, সেখান থেকে এক লাফে গিয়ে উঠলো ওকাপির খাঁচার ওপর। ওখানে বসেই গম্ভীর হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চোখ বোলালো পুরো কেবিনটায়। মুসার পাশে গাদাগাদি করে উঠে। বসলো রবিন আর কিশোর। ওড়ার সময় বসতে কষ্ট হবে না তেমন, অসুবিধে হবে ওঠা আর নামার সময় সীটবেল্ট বাঁধা নিয়ে। শেষে একটা বেল্টই ঘুরিয়ে এনে দুজনের পেটের ওপর বাঁধলো। এঞ্জিন স্টার্ট দিলো মুসা। লাফিয়ে এসে তার কাঁধে চাপলো মিস্টার কোলোবাস। চালাতে অসুবিধে হবে কিশোর পাইলটের, তাই ওটাকে সরিয়ে দিলো কাধ থেকে। কিন্তু কিভাবে আকাশে ওঠে প্লেন, দেখবেই। যেন বানরটা, অগত্যা কিশোর আর রবিনের কাঁধে ভাগাভাগি করে বসলো।
স্টর্ক নিয়ে ওঠা-নামা করতে করতে হাত অনেক পেকে গেছে মূসার। ভারি বোঝা নিয়েও সহজে উঠে গেল গাছের মাথায়।
উত্তর-পশ্চিমে নাইরোবির দিকে চলে যাওয়া লাল সড়কের ওপর দিয়ে উড়ে চললো বিমান। কিছু দূর এগিয়ে মোড় নিলো উত্তরে মাউন্ট কেনিয়ার সতেরো হাজার ফুট উঁচু চোখ ধাঁধানো চূড়ার দিকে। পেছন থেকে বইছে বাতাস। গতি বেড়ে গেল বিমানের। প্রায় আড়াই ঘন্টার পথ তিনশো মাইল, পাড়ি দিয়ে এলো দুঘন্টায়। নামলো অ্যাবারডেয়ারে, বনের কিনারে একটা ছোট ল্যাণ্ডিংফীল্ডে।
কিভাবে কি করতে হবে সব ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়েছেন মিস্টার টমসন। সেই মতোই কাজ করলো তিন গোয়েন্দা। প্লেন থেকে নেমে যেতে হবে আউটস্প্যান হোটেলে। গেম রিজার্ভে টুকে ট্রীটপসে রাত কাটানোর অনুমতি নিতে হবে ওখান থেকে।
সবে বিমানের চাকা মাটি ছুঁয়েছে, প্রায় ছুটে এসে হাজির হলো হোটেলের শ্বেতাঙ্গ শিকারী-কাম-পথপ্রদর্শক। ছেলেদের কাছে নিজের পরিচয় দিলো কল মী। হাঙ্গার, অর্থাৎ আমাকে হাঙ্গার নামে ডেকো। মিস্টার-ফিস্টার বলার ঝামেলা করতে হবে না, সে-কথাও ঘোষণা করে দিলো মুক্তকণ্ঠে।
বিমানেই রেখে যাওয়া হলো ওকাপিটাকে। ঝামেলা করবে না। প্রচুর রসালো খাবার ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে খাঁচার ওপর। রাতের খাবারের পরও প্রচুর অবশিষ্ট থাকবে, নাস্তা সারতে পারবে।
ওকে নিয়ে ভেবো না, বললো হাঙ্গার। কি নাম যেন বললে? ও, মিস্টার ওকাপি। হ্যাঁ, ওকে দেখার লোক আছে হোটেলে। এখন দয়া করে আমার জীপে ওঠো, খুশি হবো।
হাঙ্গারকে খুশি করলো তিন গোয়েন্দা। মুসার কাঁধে চড়ে বসলো মিস্টার কোলোবাস। কিছু মনে করলো না গোয়েন্দা-সহকারী। বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে কাঁচা সড়ক, জায়গায় জায়গায় কাদা। তিন মাইল ওই বুনোপথ পেরিয়ে শেষ মাথায় পৌঁছলো গাড়ি। তারপর থেকে শুরু হয়েছে দানবীয় গাছের জঙ্গল, মাথার অনেক ওপরে খাড়া উঠে গেছে টাওয়ারের মতো।