কি একখান লেজ! মুগ্ধ চোখে দেখছে মুসা। এতো লম্বা কেন? অন্য বানরের তো এতো বড় না।
হ্যাঁ, বড়ই। বত্রিশ ইঞ্চি বানরের চল্লিশ ইঞ্চি লেজ। কেন লম্বা, বলতে পারবো না। প্রকৃতির খেয়াল, নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।
তা কোথায় নিয়ে যেতে হবে এটাকে?
যেখানে বেশি নিরাপদ। এখানকার বনে ছাড়লে আবার পোচারদের খপ্পরে পড়ার ভয় আছে। আর এই অঞ্চল কোলোবাসের বাড়িও নয়। কি করে এদিকে এসে পড়লো কে জানে। উঁচু অঞ্চলে এদের বাস, বিশেষ করে অ্যাবেরডেয়ার পার্বত্য এলাকায়। বড় বড় গাছ আছে ওখানে, বাতাসে সব সময় শীতের আমেজ-বড় বড় বোম দেখছো না? চির-শীতের দেশে থাকার জন্যে ওগুলো, দরকার। ওখানেই নিয়ে গিয়ে যদি রেখে আসো, ভালো হয়।
যাবো, বলতে এক মুহূর্ত দেরি করলো না গোয়েন্দা-সহকারী। কিন্তু মিস্টার কোলোবাস যেতে রাজি হবেন তো?
না হওয়ার কোনো কারণ নেই। ফাঁসে আটকেছিলো, গলা কেটেছে। শুকিয়ে গেছে এখন।
প্রেনের ভেতর থাকবে শান্ত হয়ে?
কি জানি। তোমাদের বিশ্বাস করতে পারলে গোলমাল না-ও করতে পারে। আমাজান থেকে জানোয়ার ধরে এনেছো, কি করে সামলাতে হয় নিশ্চয় ভালো জানো। এটাকেও না পারার কোনো কারণ দেখি না।
সুন্দর মুখটা কাত করে, বড় বড় কোমল বাদামী চোখ মেলে তিন কিশোরকে, দেখছে বানরটা। দাড়ি চুলকালো। গাল আর থুতনির লম্বা সাদা রোমগুলোকে দাড়ির মতোই দেখতে লাগে। চাপদাড়ি।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। বুড়ো আঙুল কই? কেটে ফেলেছে নাকি?
না, বিদ্যে ঝাড়ার সুযোগ পেয়ে গেল রবিন। কাটেনি। কোলোবাসের থাকেই না। ভাবো একবার, বুড়ো আঙুল ছাড়া জিনিসপত্র ধরার কথা? কঠিন না? খুব কঠিন। আমার তো বিশ্বাস মানুষের বুড়ো আঙুল না থাকলে আজকের এই মানব সভ্যতাই গড়ে উঠতে পারতো না।
একেবারে ভুল বলোনি, রবিনের সঙ্গে একমত হলেন ওয়ারডেন। এসো, তোমাদের আরেক যাত্রীকে দেখবে।
ওদেরকে একটা খাঁচার কাছে নিয়ে এলেন তিনি। ভেতরে খচ্চরের সমান একটা জীব। দেখতে মোটেও খচ্চরের মতো নয়।
ইনি আফ্রিকার সব চেয়ে দুর্লভ প্রাণীদের একজন, তর্জনী তুলে জানোয়ারটার দিকে বাতাসে খোঁচা মারলেন ওয়ারডেন। মিস্টার ওকাপি।..
বিচিত্র জীব। একই অঙ্গে নানা রঙের বাহার। যেন হাতের কাছে যতগুলো রঙ পেয়েছেন শিল্পী তুলিতে লাগিয়ে সবগুলোর পরশ বুলিয়েছেন। হলুদ, লাল, পিঙ্গল, কালো, সাদা, কালচে নীল, মেরুন, কালচে-বাদামী, মাখন, কমলা, বেগুনী, সমস্ত রঙ খুব নিখুঁতভাবে লাগানো হয়েছে চকচকে নরম চামড়াটাতে।
আর একটাতেই কয়েক জানোয়ারের মিশ্রণ। মাথায় জিরাফের খাটো শিং, গায়ে জেব্রার ভোরাকাটা, বুনন কুকুরের বড় ছড়ানো কান, আর অ্যানটিলোপ হরিণের মতো সরু পায়ের খুরের ওপরে সাদা রোমশ মোজা। ও, জিভটাও অন্য জানোয়ারের, অ্যান্ট-ঈটার বা পিঁপড়ে-খেকোর। ফুটখানেক লম্বা লিকলিকে ওই জিভ দিয়ে সহজেই কানের গোড়া আর পেছনটা চুলকাতে পারে।
কোলোবাসের মতোই এটাও এখানে এসেছে অন্য জায়গা থেকে, ওয়ারডেন। বললেন। এখানকার বনে ছাড়লে মারা পড়বে। এরা থাকে উত্তর কঙ্গোর গহীন অন্ধকার জঙ্গলে। মাত্র তিরাশি বছর আগে এর নাম জেনেছে. শ্বেতাঙ্গরা। পিগমীরা। বহু আগে থেকেই জানতো, কথায় কথায় বলে দিয়েছিলো শ্বেতাঙ্গ শিকারীকে। কেউ বিশ্বাস করেনি তখন। তারপর যখন দেখে ফেললো; আর কোনো সন্দেহ রইলো না। কে জানে, আরও কতো জানোয়ার লুকিয়ে আছে ওসব জঙ্গলে, যার কথা শুনিইনি এখনও আমরা! ওকাপিটার দিকে আবার হাত তুললেন তিনি। এরা খুব লাজুক। মানুষের সামনে বেরোয় না, সাড়া পেলেই লুকিয়ে পড়ে আরও গভীর: বনে। ওভাবেই লুকিয়ে থেকেছে তিন কোটি বছর ধরে।
কপাল কুঁচকে ফেললো মুসা। তিইন কোওটি!
হ্যাঁ, উনি ঠিকই বলেছেন, জ্ঞান বিতরণ শুরু করলো আবার রবিন। অনেক পুরনো ওরা, একেবারে খান্দানী বংশ। বিজ্ঞানীরা বলেন লিভিং ফসিল,..
জ্যান্ত জীবাশ্ম, বিড়বিড় করলো কিশোর।
কি বললে? ভুরু কোঁচকালেন টমসন।
না, লিভিং ফসিলের বাংলা বললো, আগের কথার খেই ধরলো রবিন। সেই তিন কোটি বছর আগে জন্মেছিলো ওকাপির প্রথম পূর্বপুরুষ। আরও অনেক জানোয়ারই জন্মেছিলো সেই আদিম পৃথিবীতে। অনেকেরই পরিবর্তন হয়েছে, হয়। ছোট হয়েছে, নয়তো বড়। অনেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, আজ আর বেঁচে নেই .. একটাও। কিন্তু ওকাপি রয়ে গেছে, তখন যেমন ছিলো এখনও তেমনি। তবে পোচারদের পোচিং না থামালে আর বেশি দিন থাকবে বলে মনে হয় না।
না, ভাই, মরার দরকার নেই, মিস্টার ওকাপির দিকে চেয়ে হাত নাড়লো মুসা। দোয়া করি, আরও তিন কোটি বছর বেঁচে থাকো, ওয়ারডেনের দিকে ফিরলো। তা এই বিশেষ ভদ্রলোক কোথাকার বাসিন্দা? কোথায় রেখে আসতে হবে?
হেসে ফেললেন টমসন। ইনি যে কোথাকার, কি করে বলি? অবাকই লাগছে আমার, এলো কি করে এখানে? কঙ্গোতে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারলেই ভালো। হতো; সেটা সম্ভব না। আরেক জায়গায় অবশ্য রাখা যায়, ওখানে পোচারদের হাত পড়েনি এখনও। আরও কিছু দিন পড়বে বলেও মনে হয় না।
কোথায়? আগ্রহ দেখালো কিশোর।
ভিক্টোরিয়া হ্রদের একটা বড় দ্বীপে। রুবনডো-র নাম শুনেছো? পঞ্চান্ন একর জায়গা নিয়ে গভীর বন, ওকাপিরা যেরকম পছন্দ করে। ওটা একটা নিরাপদ গেম স্যাংচুয়ারি, কড়া পাহারা। তাছাড়া চারপাশে পানি, যখন-তখন ঝড় ওঠে। ক্যানূ নিয়ে যেতেই পারবে না.পোচাররা, ডুবে মরবে। তবে বলা যায় না, কোন দিন জাহাজ নিয়ে গিয়ে হাজির হবে। তবে ততোদিন নিরাপদেই থাকবে ওখানকার জন্তুজানোয়ার। এয়ারফীল্ড নেই দ্বীপটায়। মেন ল্যাণ্ডে নামতে হবে তোমাদের, তারপর বোট ভাড়া করে নিয়ে যেতে হবে। কি মনে হয়, পারবে?